ঢাকার সন্তান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতের উত্থান-পতন কাহিনী

বয়সজনিত কারণে মারা গেলেন গেলেন পুরান ঢাকার কিংবদন্তি ঢাকার কৃতি সন্তান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। যতদুর জানি ছাত্র জীবনে পাকিস্তান আমলে তিনি এনএসএফ করতেন। লন্ডনে বসবাস করে ব্যারিস্টারি পাশ করে ঢাকায় এসেই তিনি প্রথমে ওয়ার্ড চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেটা ছিলো ১৯৭৭ সালের কথা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠন করলে তিনি ঢাকার লোকদের মূল্যায়নের উদ্যোগ নেন। যার অন্যতম ঢাকার আরেক সন্তান লেফটেনেন্ট জেনালের মীর শওকত আলী বীরউত্তম। শওকত আলীকে ঢাকার লোক হিসেবে মূল্যায়ন করে সেনা শাসনকালীন সময়ে ঢাকা উন্নয়ন কমিটি গঠন করে ওই কমিটির চেয়ারম্যান করেছিলেন জিয়াউর রহমান।

ট্রেনে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে বর্তমান এলডিপি নেতা কর্নেল অলির সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় লেখক ইকবাল কবির

 

বছর দুই আগে ট্রেনে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় বর্তমান এলডিপি নেতা কর্নেল অলি আহমদের সঙ্গে আমার কথা হয়। আমি পুরান ঢাকার সন্তান হওয়ায় তিনি বলছিলেন, জিয়াউর রহমানের এডিসি থাকাকালে তিনিই ঢাকার লোকদের মূল্যায়ন করার জন্য জিয়াউর রহমানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন । কয়েক ঘন্টার ট্রেন ভ্রমণে কর্নেল অলি বলেছিলেন, ওই সময়ে কিভাবে ঢাকার সন্তানদের জিয়াউর রহমান মূল্যায়ন করেছিলেন। জেনারেল শওকত ছাড়াও ঢাকার সন্তান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত ও মাহুতটুলির ওয়াহিউল্লাও মূল্যায়িত হয়েছিলেন।

ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত প্রথমে ১৯৭৮ সালে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন জাগো দলের ঢাকা মহানগরীর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এরপর জাগো দল থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে যোগদান করে ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্ব নেন। তখন এভাবে থানা কমিটি ছিলোনা। ঢাকা মহানগর বিএনপি প্রতিটি পঞ্চায়েত ভিত্তিক মহল্লা কমিটি গঠন করে মহানগর কমিটিতে জমা দিতো। এর উদ্দেশ্যে ছিলো একটিই, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বিএনপি প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র ১৯ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নে পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লার পঞ্চায়েতকে যুক্ত করে দলকে সংগঠিত করা। এই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা, আর ঢাকা পৌরসভা থেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে উন্নিত করে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করা। এরপরই ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান পদটিকে মেয়রে পরিনত এবং ওয়ার্ড চেয়ারম্যানদের পদকে কমিশনার পদ করা হয়।এই কমিশনারদের মধ্যে থেকে মেয়র প্রার্থী ও কমিশনারদের ভোটেই মেয়র নির্বাচন করার বিধান করা হয়। আর ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত হন পরোক্ষ ভোটে ঢাকার প্রথম মেয়র। ওই সময় ঢাকা পৌরসভার সর্বশেষ চেয়ারম্যান ছিলেন মালিটোলার ফজলুল করিম। তিনিও ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হয়ে ঢাকার মেয়র পদে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতের সঙ্গে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। মেয়র ভোট গোপন ব্যালটে দেয়ার রীতি থাকলেও তা পরিবর্তন করে প্রকাশ্যে ওয়ার্ড কমিশনারদের হাত তুলে ভোট ও মেয়র নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলে ফজলুল করিম এর প্রতিবাদ করে মেয়র নির্বাচন বয়কট করেন। যার ফলে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত বাধাহীনভাবেই ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত তৎকালীন ধানমন্ডি- লালবাগ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঢাকার লোক হিসেবে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতকে জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ, গৃহায়ণ, নগর উন্নয়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও করা হয়।

ঢাকার সন্তান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত স্বাধীনতার পর এতো দ্রুত উত্থানে নজীর স্থাপন করেন। ব্যারস্টার হাসনাতের নেতৃত্বে ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষাসহ খেলার মাঠ, শিশুদের বিনোদনের জন্য শিশু পার্কসহ বহু উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ব্যারিস্টার হাসনাতই প্রথম ঢাকায় বিডিআরের কাছ থেকে জায়গা নিয়ে হাজারীবাগের পাশ থেকে বিডিআর দুই নাম্বার গেট পর্যন্ত বিডিআরের কাঁটাতার বেষ্টনী সরিয়ে সড়ক প্রশস্ত করেন। আজ পর্যন্ত কোন সরকার বিডিআরের কাছ থেকে রাস্তা আদায় করতে পারেননি।। আজকের লালবাগ কেল্লার ঐতিহ্য ও হেরিটেজ হিসেবে সাউন্ড সিস্টেম চালু করে যারা গর্ববোধ করেন ১৯৮০ সালে লালবাগ কেল্লার ভেতরে উন্মুক্ত মাঠে বিশাল সমাবেশে জরাজীর্ণ ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া লালবাগ কেল্লাকে সংরক্ষণের ঘোষণা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। এরপর থেকেই লালবাগ কেল্লাকে সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু হয় এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে বিশ্ব দরবারে আজও পুরান ঢাকার গৌরব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত মন্ত্রী ও মেয়র থাকাকালীন মাত্র অর্ধ দশক বিএনপির রাজনীতিতে থাকাকালীন সময়ে নানা বিষয়ে অভিযুক্তও হন। ১৯৮২ সালে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর সেনাশাসক এরশাদের সামরিক জালে বন্দী হন এবং তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। মার্শা‘ল কোটে বিচার করে ১৪ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।এরপর দেশের সামরিক শাসন প্রত্যাহার হলে আবুল হাসনাত জামিনে মুক্তি লাভ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন চলে যান। সেখান থেকে ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরে আবার ঢাকা মহানগর বিএনপি‘র সভাপতির দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বে ঢাকায় বিএনপির এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হলে এরশাদ আবুল হাসনাতকে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করাতে পুরোনো মামলাগুলো দ্রুত পূণরুজ্জীবিত করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালে নভেম্বরের শেষ দিকে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে ঢাকার ধানমন্ডি উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমে এমপি পরে আবার ঢাকার (তখন সরকার কর্তৃক মনোনীত) মেয়র হন। মাত্র দুই সপ্তাহ মেয়র থাকার পরই এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ওই সময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে হাসনাতের লালবাগের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করা হয়। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই তাকে আটক করা হয়। একটি দুর্নীতির মামলায় তার ৬মাসের কারাদন্ড হয়। এরপর থেকে হাসনাত জাতীয় পার্টির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।

১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আকস্মিকভাবেই আবার বিএনপিতে ফিরে ঢাকা-৮ (তৎকালীন লালবাগ-হাজারীবাগ-কামরাঙ্গীরচর) আসনে নির্বাচন করে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হাজী মোঃ সেলিমের কাছে হেরে রাজনীতি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন। রাজনীতিতে ঢাকার এই কৃতি সন্তান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত ঢাকার মেয়র হয়ে ঢাকার লোকদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। অনেককে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন, যাদের মধ্যে তৎকালীন লালবাগ থানা এলাকার হোসেনী দালান এলাকার জনপ্রিয় কাউন্সিলর প্রয়াত গোলাম মোর্শেদ, লালবাগ ভাটমসজি এলাকার প্রয়াত আহমেদ আলী মানিক অন্যতম।

ব্যারিস্টার হাসনাতের উত্থান সেনাসশাকদের হাত ধরে হলেও তিনি রাজপথের আন্দোলনে সিভিল রাজনীতিতে কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি। তাই ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তার ভরাডুবি ও পরাজয়ের জন্য স্থানীয় বিএনপি ও একজন ছাত্রনেতাকে অভিযুক্ত করেন এবং অভিমানে রাজনীতি থেকে দূরে চলে যান। এভাবেই দুই যুগের বেশী (২৬ বছর) সময়ে আইনী পেশায় থেকে কখনও ঢাকা, কখনো লন্ডনে কাটিয়েছেন।

১৯৮৭ সালে পুরান ঢাকার হাজারীবাগ পার্কে জিয়া স্মৃতি কিশোর ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব কে.এম.ওবায়দুর রহমান, তার বাম পাশে লেখক সাংবাদিক ইকবাল কবির ও পেছনে রাইট চিহ্নিত ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত

 

১/১১ এর সেনাশাসনের সময় আমি ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম তার রাজনৈতিক অবস্থান জানার জন্য। তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘তিনি আর এই বিশ্বাসঘাতক ও নষ্ট প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চান না“। ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরার পরপরই। হাজারীবাগ বটতলার আব্দুল লতিফ বিএনপি করতেন।তিনি আমাকে একদিন জোর করে বেবীটেক্সিতে তুলে তার বনানীর বাড়িতে নিয়ে যান। সেই সামনা সামনি পরিচয় বললেন, ‘তোমার কথা শুধু শুনি। আমিই লতিফকে বলেছি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে।‘ সেই থেকেই পরিচয়। পুরান ঢাকার ছেলে হিসেবে আমাকে অনেক বিশ্বাস ও স্নেহ করতেন। আমি পুরান ঢাকার ছোট বড় যেকোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেই তিনি চলে আসতেন। এরশাদ সরকারের শাসনামলে তিনি আমার পুরান ঢাকার হাজারীবাগে বহুবার এসেছেন। ১৯৯৬ সালে তার নির্বাচনকালীন সময়ে বিভিন্ন লোক মারফত আমাকে খুঁজেছেন, ওরা বলেছিলো বিদেশ চলে গিয়েছে। তাই তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ১৯৯০ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিং পুল মার্কেটের ভিডিও দোকানের আড্ডায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক ভাই আমাকে বললেন, ‘আপনার হাসনাত সাহেব সন্ধ্যায় মেয়র হিসেবে শপথ নিচ্ছেন জানেন‘? তাৎক্ষনিক ল্যান্ড ফোনে ফোন দিলাম। তিনিই ফোন ধরলেন, হাল্কা সুরে জানতে চাইলো কে,পরিচয় দিতেই বললো, ‘যা শুনেছো সঠিক সন্ধ্যায় টিভি দেখবা‘। বাসায় এসো পরে সব বলবো। পরে জেনেছিলাম খুব চাপে পরেই বিএনপি ছাড়তে হয়েছিলো তাকে। সাংবাদিকতাকালীন সময়ে বহুবার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কখনও সময় নেই বলেননি। বলতো চলে এসো দিলকুশার আইন পেশার চেম্বারে। এরশাদের আমলে আলোচিত হাইকোর্ট বিভাগীয় শহরে বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে মামলায় তিনি হাইকোর্ট সংবিধান অনুযায়ী ঢাকায় থাকার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এবং ওই মামলায় সরকার পক্ষ হেরে যায়। সাপ্তাহিক সুগন্ধা পত্রিকায় আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আইনের দরজা নক করলে কেউ খালি হাতে ফিরে না‘। জানি না তার এই মূল্যায়ন এখন কতটুকু বাস্তব সম্মত? ঢাকার কৃতি সন্তান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। নিশ্চয়ই আমরা মহান আল্লাহর জন্য, আমরা তার দিকেই ফিরে যাবো। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ওপারে তিনি যেন ভাল থাকেন।

স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন  সিটিজি সংবাদের ঢাকা ব্যুরো প্রধান ইকবাল কবির।