পুকুর চুরি-পুকুর রক্ষা
লেখাটি দৈনিক আজাদী থেকে নেয়াঃ
পুকুর চুরি। শব্দটা আমরা প্রায় সকলেই জানি। কিন্তু এই শব্দটা অন্য কোনো ভাষায় আছে কিনা জানি না। আর একান্তই যদি ইংরেজিতে হয়, তবে বলতে হবে ‘পন্ড থেপ্ট’ (Pond theft )। বাংলা যত শ্রুতিমধুর ইংরেজিতে তা মোটেও নয়।
এই লেখা আরম্ভ করার আগে আমাদের রিপোর্টার মোরশেদকে বলেছিলাম পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নগরীর পুকুরের কোনো পরিসংখ্যান থাকলে জানাতে। পরিবেশ অধিদপ্তর কিছুই জানাতে পারেনি। তবে সে আমাকে যা জানিয়েছে তা মৎস্য অধিদপ্তরের জরিপের ওপর ভিত্তি করে।
২০২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর একবার উদ্যোগ নিলেও পরে ওই জরিপ কার্যক্রম থমকে যায়। এখানে বলে রাখা ভালো, পুকুর ভরাটের কোনো ঘটনার কথা কেউ উনাদের জানালে উনারা সেখানে অভিযান চালান ও মামলা দায়ের করেন। চলতি বছর এই পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রায় ৪১ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮১ সালের এক জরিপে এই নগরীতে ২৫ হাজার পুকুর ও জলাশয় ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ২০০৬-২০০৭ সালের জরিপে জলাধার পাওয়া যায় মাত্র ৪ হাজার ৫২৩টি। পরবর্তীতে তাদের উদ্যোগে আর কোনো জরিপ হয়নি। ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল বিজ্ঞান’এর ১২তম সংখ্যায় চট্টগ্রামের জলাশয়ের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ‘Identification and classification of urban water Bodies in Chittagong metropolitan city of Bangladesh, A Geographic Inventory ’ নামে ১৯ পৃষ্ঠার ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ১২৪৯ জলাশয়ের উল্লেখ আছে, যার মধ্যে ৯৮০টি পুকুর ও ১৪৮ ডোবা। এই গবেষণার জন্য পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন মোল্লা মাঠপর্যায়ে জরিপ চালান ২০১৬-২০১৭ সালে। জরিপের শুরুতে তিনি স্যাটেলাইট থেকে ধারণকৃত ছবিতে ১৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করেন।
পুকুর চুরি হচ্ছে কেন? উত্তর খুব সহজ। কারণ জায়গার দাম বেড়েছে। চট্টগ্রাম শহরে এক কাঠা জায়গার দাম কমপক্ষে এক থেকে দুই কোটি টাকা। একেকটা পুকুর বা জলাশয় ৮/১০ কাঠা থেকে কয়েক বিঘা হতে পারে। ফতেয়াবাদ বড় দিঘি যে কত বিঘার তা আমি বলতে পারব না। শহরে এত বড় না হলেও এখনো অনেক বড় বড় দিঘি আছে। যেমন আসকার দিঘি, বলুয়ার দিঘি, আগ্রাবাদ ডেবা, পাহাড়তলীতে ভেলুয়ার দিঘি। আসলে যারা মালিক তাদের কথাও ভাবতে হবে। পুকুরটা যেনতেনভাবে ভরাট করতে পারলেই তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হবেন। তারাই-বা বঞ্চিত হবেন কেন? এখানে সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন যৌথভাবে শহরের পুকুরগুলো যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে অধিগ্রহণ করতে পারে। তাহলে মালিকও ঠকল না, জলাশয়ও রক্ষা পেল। কলকাতায় আমি দেখেছি প্রতিটি পুকুর শান বাঁধানো, পাড়ে বাগান এবং সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন। বসার জন্য পাকা বেঞ্চ। চারদিকে লোহার তার দিয়ে ঘেরা। এলাকাবাসী সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে, গল্প করছে। আমাদের শহরেও কি ঠিক সেভাবে পুকুরগুলোকে গড়ে তোলা যায় না? নিশ্চয়ই যায়। শুধু সদিচ্ছার অভাব।
শহরে বিশেষ করে শীতের সময় এবং শর্ট সার্কিট, গাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘরবাড়িতে আগুন ধরে যায়। তখন জলাশয় থেকে ফায়ার সার্ভিস পানি সংগ্রহ করতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে আমার বাড়ির উল্টো দিকে চাক্তাই খালের পূর্বপাড়ে বস্তিতে আগুন লেগেছিল। ফায়ার সার্ভিসের কোনো গাড়ি সেখানে পৌঁছাতে না পেরে এই পাড়ে আমার বাসায় এসে আমার পুকুর থেকে পানি দিয়ে আগুন নিভিয়েছিল।
তার ওপর জলাশয়/পুকুর আপনাকে নিয়মিত পুষ্টিকর তরতাজা মাছ সরবরাহ করে। আর কিছু না হলেও কয়টা তেলাপিয়া ছেড়ে খাবার দেন। কিছুদিন পর পর আপনি সেই জলাশয় থেকে ফরমালিনমুক্ত মাছ তুলে খেতে পারবেন। তবে সাবধান, ছোট ছেলেমেয়েদের যারা সাঁতার জানে না তাদের ভুলেও জলাশয়ের কাছে যেতে দেবেন না।
আর একটু বলেই আমি আমার লেখা শেষ করব। পুকুরের মালিকেরা আমাকে গালি দেবেন না। কারণ একটু আগেই আমি আপনাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাটা লিখেছি। পুকুর/জলাশয় রক্ষার জন্য তা সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন একটা নিয়ম করতে পারে, তা হলো পুকুর ভরাট করলে কাঠা হিসাবে স্থানীয়ভাবে ওই জমির যা দাম তা জরিমানা করা হবে এবং ভরাট করা পুকুর বা জলাশয়ের জায়গায় সিডিএ কোনোদিনই বাড়ি করার জন্যে কোনো প্ল্যান পাস করবে না। পুকুর কিংবা জলাশয় রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে একদিন আমাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।
লেখক : মো. আবদুল মালেক, সম্পাদক, দৈনিক আজাদী