পরিবেশ দূষণে প্লাস্টিক-পলিথিনের দাপট

হাসান সৈকত ::

  • চট্টগ্রামে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন
  • সরকারি বিশেষ সহায়তা চান প্লাস্টিক রিসাইক্লিংকারীরা
  • দেশে পুনর্ব্যবহার হয়েছে মাত্র ২০ ভাগ

বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের পরিবেশ ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। ক্রমান্নয়ে বাড়ছে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের পরিমাণ। সময়ের সাথে সাথে এই দূষণের প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও প্রকৃতিতে বসবাস করা সকল ধরনের প্রাণি ও জনজীবনের ওপর।

মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে আমাদের পরিবেশ আজ ধ্বংসের মুখে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার। এর অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্রের উপর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।
প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে ভয়ের দিকটি হচ্ছে এর দীর্ঘস্থায়িতা। বহু বছর পর এটি ভেঙে গিয়ে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ৫ মিলিমিটারের চেয়েও কম। যা সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে বাতাস সবখানেই এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এই ছোট ছোট কণাগুলো খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্ম দেয়।

বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। যার মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ প্লাস্টিক পুনর্চক্রায়িত ও ৩৯ ভাগ ভূমি ভরাটে ব্যবহৃত হয়। তবে বাকি ২৫ ভাগই সরাসরি যুক্ত হচ্ছে পরিবেশের দূষক হিসেবে।

বিজ্ঞানীদের তথ্য মতে, প্লাস্টিক পণ্য মাটির সাথে মিশতে সময় নেয় প্রায় ১ হাজার বছর। এর মধ্যে একটি প্লাস্টিক বোতলের সময় লাগে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ বছর।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম। এটিকে বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা হয়। জীবনজীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত মানুষ শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রামের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ লক্ষের বেশি। আর এই বাড়তি জনসংখ্যায় শহরাঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানবসৃষ্ট বর্জ্যরে পরিমাণও। চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার ৭৫% বর্জ্য সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য প্রতিবেদন ২০১৯-২০২০ এর তথ্যমতে, বাকী ২৫% বর্জ্য অসংগ্রহীতই থেকে যায়।

এই ধরনের অসংগ্রহীত বর্জ্য চট্টগ্রাম নগরীতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যেমন পানি নিষ্কাশনে বাধার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, আগুনে পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণ, মাইক্রোপ্লাস্টিকে স্বাস্থের ঝুঁকি ইত্যাদি।

২০২২ সালের তথ্যানুযায়ী বিশ্বে বায়ু দূষণে দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল অষ্টম। এছাড়াও নগর হিসেবে দূষণের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়।

প্লাস্টিক দূষণের কারণে হ্রাস পায় মাটির উর্বরতা, বাধাগ্রস্ত হয় উৎপাদনশীলতা। প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে প্লাস্টিকের একটি বড় অংশ জমা হয় ময়লার ভাগাড়সহ নদী-নালা, খাল-বিলে। যা মাটির সাথে মিশতে সময় লাগে বছরের পর বছর। যার ফলে, পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। জলাবদ্ধতাও স¦াস্থ ঝুঁকির অন্যতম কারণ। বদ্ধ জলাশয়ের দূষিত পানিতে জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগবাহিত এডিস মশাসহ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো নানা ধরনের রোগবালাই।

প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে পরিবেশে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায়, যা বায়ু দূষণে অন্যতম কারণ। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগব্যাধির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

প্লাস্টিক দূষণ রোধে জাতীয় মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও ২০২০ সালে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ লাখ টনের মতো, যা মোট ব্যবহারের মাত্র ২০ ভাগ।
গবেষকরা মনে করেন, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ৩৩ বিলিয়ন টন প্লস্টিক জমা হতে পারে। গ্লোবাল প্লাস্টিক আউটলুক অনুসারে ২০১৯ সালে বিশ্বে ৩৫৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে যা ২০০০ সালের দ্বিগুণেরও বেশি।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রতিদিন রাস্তা, নির্মাণাধীন ক্ষেত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে ৫১০ টন, গৃহস্থালী থেকে ১ হাজার ৮৩০ টন, মার্কেট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে ৬৬০ টন ও ১.৫ টন মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করে। এসব বর্জ্য চট্টগ্রামের হালিশহর ও আরেফিন নগরে সংরক্ষণ ও রিসাইক্লিং করা হয়।

ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্জ্য সংগ্রহকারীরা বিভিন্ন উৎস থেকে প্লাস্টিক/পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহ করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করেন। চট্টগ্রামে প্রায় তিনশ’র অধিক রিসাইক্লিংকারী আছে যারা বিভিন্ন ভাঙারি দোকান থেকে প্লাস্টিক ও পলিথিন সংগ্রহ করেন।

প্লাস্টিক রিসাইক্লিং মূলত বেসরকারিভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। যার ফলে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন প্রযুক্তিগত যন্ত্রের স্বল্পতায় ভোগেন।

চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বাস্তুহারা এলাকার একটি রিসাইক্লিং কারখানা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, যদি সরকারিভাবে বিশেষ সহায়তা পেয়ে থাকেন তবে প্লাস্টিক বর্জ্যের সংগ্রহ বহুগুণে বেড়ে যাবে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে চট্টগ্রাম নগরসহ দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর।

জানা গেছে, প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল হচ্ছে দেশের প্রায় ৫ হাজার কারখানায়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে আছে তিনশ’র অধিক। এসব কারখানায় প্রতি মাসে প্রায় কয়েক হাজার টন প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হচ্ছে। চায়না, বেলজিয়াম, ভিয়েতনাম, ভারতসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয় এই প্লাস্টিক ফ্লেক্স। সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি শুধু দেশের প্লাস্টিক বর্জ্যই হ্রাস করছে না, সেইসঙ্গে অর্জন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এসব কারখানা চালাতে তাদের পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও শিল্পকারখানা অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয়।

ইপসা’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্জ্য সংগ্রহকারীরা পলিথিন সংগ্রহ করতে চান না। কারণ এসব পলিথিন পাতলা এবং এর বিশেষ অর্থনৈতিক মূল্য নেই। হালকা পলিথিন ও সিংগেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্যরে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে অপর্যাপ্ত সংগ্রহের কারণে রিসাইক্যালারদের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তবে কিছু কিছু এনজিও এ সেক্টরে কাজ করে বিষয়টির ইতিবাচক পরিবর্তণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাদের প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে  রিসাইক্যালার ও ভাঙারির দোকানিদের সাথে একটি যুগসূত্র স্থাপন হয়েছে। একটা সময় ভাঙরির দোকানিরা কোথায়, কার কাছে বিক্রি করবে তা নিয়ে হিমসিম খেত। তবে এখন সুসম্পর্কেও কারণে রিসাইক্যালাররা খুব সহজেই প্লাস্টিক বর্জ্য কিনতে পারেন।

পরিবেশ ঠিক থাকলে দেশের মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে। মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। আমরা প্রকৃতিকে দূষণমুক্ত রাখতে চাই। আমাদের একটাই লক্ষ্য, প্রকৃতিকে কিভাবে আরো উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে পারি। এ সেক্টরের ব্যবসায়ীরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে বলে তাদের দাবি। ব্যবসার চেয়েও প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যে বিরূপ প্রভাব ফেলে তা থেকে উত্তোরণের পথ এ সেক্টরে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এমনটা চান সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ।

লেখক : হাসান সৈকত, গণমাধ্যমকর্মী, চট্টগ্রাম।

আরও পড়ুন