জাতিসংঘ পার্ক হচ্ছে সবুজ উদ্যান : সরাতে হবে চসিকের পুল-জিমনেশিয়াম

দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন :: নগরের পাঁচলাইশ জাতিসংঘ পার্ককে সবুজ উদ্যান হিসেবে গড়ে তুলতে ১১ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার টাকার একটি প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ‘পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। বর্তমানে পার্কটির একপাশে ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) অর্থায়নে তিন কোটি ৯৪ লাখ টাকায় নির্মিত দুইটি সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধার্থে সুইমিং পুল দুটি এবং জিমেনেশিয়াম অপসারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চসিককে চিঠি দিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, নকশা চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। নকশা পেলেই আমরা তিন-চার মাসের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করে কাজ শুরু করতে পারব।

বিদ্যমান সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। তাদেরকে বিষয়টি আগেও জানিয়েছিলাম। প্রকল্প অনুমোদনের পর আনুষ্ঠানিক চিঠিও দিয়েছি।

এ বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, গণপূর্ত বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করবে। সুইমিং পুল ও জিমেনিশয়াম উচ্ছেদের বিষয়টি প্রকল্পে ধরা আছে।

প্রকল্পে যা আছে : সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়ামের জায়গাসহ পুরো পার্কটির উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাল্টে যাবে পার্কটি। এটা সবুজে ভরে উঠবে। চারপাশে দেয়া হবে সীমানা দেয়াল। নির্মাণ করা হবে ওয়াকওয়ে। দর্শনার্থীদের বসার জন্য থাকবে বেঞ্চ। মাঝখানে ঝর্ণা থাকবে। লাইটিং করা হবে। টয়লেট জোন থাকবে। বাউন্ডারি করা হবে গ্রিল দিয়ে। যাতে বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যায়। বর্তমানে পার্কটি চারপাশের রাস্তার চেয়ে প্রায় পাঁচ ফুট নিঁচু। ফলে বৃষ্টি হলে সেখানে পানি জমে যায়। তাই পাঁচ ফুট উচ্চতা ধরে প্রকল্পে ভূমি উন্নয়ন ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। পার্কে শিশুদের জন্য খেলাধূলার সরঞ্জাম থাকবে এবং শরীর চর্চার জন্য হরিজন্টাল বারও স্থাপন করা হবে। থাকবে দুইটি মেটাল পারগোলাও।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করা হবে দুই কোটি ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়। এছাড়া অফিস, দোকান ও টিকেট কাউন্টারসহ প্রবেশ গেইট নির্মাণ করা হবে এক কোটি ৪০ লাখ টাকায়, দুই কোটি ১৯ লাখ টাকায় দুই হাজার ৯৪০ বর্গমিটার ওয়াকওয়ে, ৩৫ লাখ টাকায় ৪৪টি আরসিসি বসার সিট এবং ৩০ লাখ টাকায় ৮ হাজার ৩৩ ঘনমিটার মাটি দিয়ে পার্কের ভূমির উন্নয়ন করা হবে।

ছয় বছরের জটিলতার অবসান : প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদন পায় গত ৪ জুলাই। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তর প্রকল্পটি গ্রহণ করে ২০১৭ সালে। ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর চসিকের তৎকালীন মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে একটি পত্র দেন। এর কয়েকদিন পর ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায়ও চসিক প্রতনিধি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির বিরুদ্ধে আপত্তি জানান। এতে স্থগিত করা হয় গণপূর্তের প্রকল্পটি।

এর আগে ২০১৬ সালে পার্ককে ঘিরে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় চসিক। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আজাদীতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির পক্ষে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। এতে আটকে যায় চসিকের প্রকল্প। তবে ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর পার্ককে ঘিরে চসিকের গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্যকে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি চসিক। আবার আটকে থাকে গণপূর্তের প্রকল্পটিও।

এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে আ.জ.ম নাছির উদ্দীন ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন পারস্পরিক আলাপে একমত হন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিকে হস্তান্তর করবে। পরের বছর প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকালে খোরশেদ আলম সুজন গণপূর্ত অধিদপ্তরকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাপত্তি পত্র দেয়। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির করা রিটটিও প্রত্যাহার করা হয়। ফলে গতি পায় গণপূর্তের প্রকল্প।

পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় গণপূর্তের প্রকল্পটি নিয়ে একাধিক পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রকল্পটি সংশোধন করে গত ১৮ মে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ চলতি মাসে পরিকল্পনা কমিশন চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এর ফলে পার্ক ঘিরে ছয় বছরের জটিলতার অবসান হলো।

উল্লেখ্য, ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেক সভার অনুমোদন প্রয়োজন হয়। ওই হিসেবে জাতিসংঘ পার্ক উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে একনেক সভার অনুমোদন লাগবে না। অর্থাৎ পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন হওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরো পার্কটি দুই দশমিক ২৭ একর জায়গার উপর অবস্থিত। চসিক ২০০২ সালে জাতিসংঘ পার্ক নামকরণ করে। পার্কটির মালিকানা নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর চসিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল। সেটা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

পরিদর্শনে মেয়র : জাতিসংঘ পার্ক সংস্কার ও পুর্ননিমাণের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন ও গণপূর্ত বিভাগ সমম্বয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। গতকাল বুধবার পার্কটি পরিদর্শনে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
মেয়র বলেন, নগরে দিন দিন খোলা জায়গা কমে আসছে। সংকুচিত হয়ে আসছে বিনোদন ও খেলার মাঠ। নগরের মানুষের যান্ত্রিক জীবনধারার অবসরে একটু বিনোদন ও স্বস্তি দিতে গণপূর্ত বিভাগ জাতিসংঘ পার্কটি নির্মাণ করে সঠিক কাজটিই করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই পার্কের আর কোনো উন্নয়ন হয়নি।

তিনি বলেন, নানান জটিলতা ও সঠিক পরিচর্যার অভাবে পার্কটি চরম অবহেলার শিকার। সুন্দর মনোরম পরিবেশে পার্কটি নির্মাণ করা হলেও এখন আর সে পরিবেশটি নেই। ফলে মানুষের আকর্ষণ হারিয়ে পার্কটি অনেকটা পরিত্যক্ত স্থানে পরিণত হয়েছে। এ পার্কটির যথাযথ সংস্কার ও আশপাশকে পরিচ্ছন্ন করে তুলে আধুনিকতার পরশে নতুন করে সাজাতে পারলে মানুষ চিত্ত বিনোদন ও অবসর সময় কাটাতে আবারো পার্কটিকে বেছে নিবে, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

পরিদর্শনকালে মেয়রকে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ তাদের গৃহীত প্রকল্পের নানা দিক সম্পর্কে অবহিত করেন। মেয়র পার্কের লে-আউট পর্যালোচনা করেন। এ সময় মেয়রের একান্ত সচিব মো. মুহাম্মদ আবুল হাশেম, প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন