সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তথা অ্যাপস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বাইকার উভয়ের অধিক মোনাফার লোভের বলি হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে বন্ধের পথে রাইড শেয়ারিং সেবা তথা ব্যবসা। মাত্র পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া দারুণ ও সময়োপযোগী এ পদক্ষেপ লোভ আর নানা জটিলতার কাছে হার মেনে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। পথে ঘাটে এখনও রাইড শেয়ারিংয়ের প্রচুর বাইকের দেখা মিললেও তারা কেউ অ্যাপসে যেতে রাজী নন, দরদাম করে অফলাইনেই তারা যাত্রী নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কোভিড-১৯ এর সময়ে ব্যপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মোটর বাইক রাইড শেয়ারিং। রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করায় তখন অনেক বেকার যুবকই এ পেশায় নিজেকে যুক্ত করে জীবিকা নির্বাহের পথ বেছে নিয়েছিলো। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া, ডিজিটাল পেমেন্টে রাজি না হওয়া ও যাত্রী হয়রানি, ডিজিটাল পেমেন্ট না নেয়া, রাইড অর্ডার বাতিল করা, চুক্তি ভিত্তিক অনিরাপদ যাত্রায় আগ্রহী হওয়াসহ নানা কারণে গ্রহণযোগ্যতা ও রূপ জৌলুস সব হারিয়ে রাইডি শেয়ারিং কনসেপ্টটি এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই সাথে রোদ বৃষ্টির ঝামেলায়ও যাত্রীরা অনেক সময় এড়িয়ে যাচ্ছেন রাইড শেয়ারিংয়ের যাত্রা।
পাঁচ বছর আগে কর্মব্যস্ত শহরে নগরবাসীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে নিরাপদ, স্বস্তিদায়ক করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে বাজারে আসে অ্যাপভিত্তিক দেশের প্রথম রাইড শেয়ারিং কোম্পানি উবার। একে একে পাঠাও, ওভাইসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান এসেছে। তবে অধরাই রয়ে গেছে যাত্রীদের আরামদায়ক যাতায়াতের স্বপ্ন। আয়ের একটি বড় অংশ কমিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয় বলে চালকরা অ্যাপ ব্যবহার করতে চান না। চুক্তিভিত্তিক ছাড়া যেতে চান না অধিকাংশ চালক। আবার চুক্তিতে গেলে অনিরাপদ ভেবে যাত্রীরাও আগ্রহী নন রাইড শেয়ারিংয়ে চলাচল করতে। ফলে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে এ পরিষেবা।
জানা গেছে, অ্যাপভিত্তিক প্লাটফর্মগুলো ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন নেয়। কিন্তু জ¦ালানী তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে এত কমিশন দিয়ে গাড়ী চালিয়ে পোষায় না বলে দাবি রাইডারদের। তাই অ্যাপের পরিবর্তে চুক্তিতে যাত্রী নিতে চান রাইডাররা। যাত্রীরা চুক্তিতে যাওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় তৈরী হয়েছে সংকট। তাছাড়া মাস শেষে ব্যাংক ঘুরে নিজের একাউন্টে টাকা জমা হতে সময় নেয়ার কারণেও অনেক রাইডার অ্যাপসের পরিবর্তে চুক্তিতে ভাড়া নিতে আগ্রহী।
পথে পথে পুলিশী হয়রানি আর নানা অনিয়মের কারণেও অ্যাপস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় বন্ধের পথে। করোনার ধাক্কা ও চুক্তিভিত্তিক চালানোর প্রবণতায় অ্যাপ ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া চট্টগ্রাম শহর হিসেবে ঢাকার মতো বড় পরিধির না হওয়ায় অ্যাপে ভাড়া কম ওঠে। ফলে চুক্তিভিত্তিক হলে বেশি ভাড়া পাওয়া যায় আর কোম্পানীর কমিশনও বেছে যায়।
চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ মোড়ে বাইকার মামুন বলেন, আমি একটি গার্মেন্স কোম্পানীতে জব করতাম। কোভিড-১৯ এ সময়ে আমার জব চলে যায়। এরপর আমি রাইড শেয়ার শুরু করি। তখন দু‘এক বেলা রাইড করেই মাসে ভাল একটা আয় হতো। কিন্তু এখন সারাদিন চালিয়ে ১হাজার টাকা তুলতে পারি না।
বড়পোল মোড়ে রাইডার ইমাম বলেন, আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করতাম। আমার পরিচিত একজনের কথায় লকডাউনের সময় চাকরী ছেড়ে লোন নিয়ে একটি বাইক নেই। মাত্র ৫ মাসে আমার বাইকের ঋন পরিশোধ করেছি। আমার দেখাদেখি অনেকেই বাইক কিনেছিল। তখন রাস্তায় ছিল প্রচুর যাত্রী। কিন্তু এখন যাত্রীর জন্য অপেক্ষার যেন অন্ত নেই। বিশেষ কিছু পয়েন্ট এবং সময় ছাড়া সারাদিন যাত্রী নেই বললেও চলে।
এদিকে রাইডাররা যত্রতত্র যাত্রীর জন্য গাড়ী নিয়ে দাড়িয়ে থাকায় যানজটও তৈরী হয়। তাদের জন্য নির্দিষ্ট দাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। যেখানে দাড়িয়ে যাত্রী তুলে সেখানে স্থানীয় প্রভাবশালীদেরকেও চাঁদা দিতে হয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় এনে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য রাইড শেয়ারিং সেবা সচল রাখতে প্রয়োজন প্রশাসন ও অ্যাপস কোম্পানী এবং রাইডারদের ত্রি-মুখী সমঝোতা বা সমন্বয়। তবেই এ পরিষেবা ফিরে পাবে তার জৌলুশ। অপরদিকে অ্যাপসে রাইড শেয়ারিং না করে চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহন করলে সংশ্লিষ্ট চালক ও যাত্রীর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেই দায় সারছেন বিআরটিএ। অথচ তাদের নজরদারির ঘাটতি, বিআরটিএর প্রযুক্তির ব্যবহারে অদক্ষতার কারনে অ্যাপস প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভিস চার্জ আদায় করার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম, কাংখিত গন্তব্যে না যাওয়া এবং বেশি চার্জ আদায় করে যাত্রীদের হয়রানি করার বিস্তর অভিযোগের কোনো সুরাহা না হওয়ায় ভাটা পড়েছে অ্যাপে রাইড শেয়ারিং।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এখানেও অরাজকতা। অ্যাপস কোম্পানীগুলোর অতিরিক্ত কমিশন আদায়ের কারণে রাইডার’রা চুক্তিতে যাত্রী নিতে আগ্রহী। ফলে অনিরাপদ জেনেও কিছুটা কম টাকায় যাত্রীরা চুক্তিতে যেতে আগ্রহী হন। তাছাড়া পুলিশী হয়রানি বন্ধ করে যথাযথ পার্কিং সুবিধা রেখে অ্যাপের কমিশন কমালে আবারও এ পরিষেবা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।