প্রশাসন নির্বিকার

বান্দরবান যেনো অবৈধ বার্মিজ গরু’র নিরাপদ প্রবেশদ্ধার

বান্দরবানের তিনটি উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে বার্মিজ গরু। এ জনপদ যেনো বার্মিজ গরু প্রবেশের স্বর্ণদ্ধার।এই তিনটি উপজেলা হচ্ছে আলীকদম, নাইক্ষংছড়ি ও লামা। আলীকদম ও নাইক্ষংছড়ি উপজেলা মায়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় ৮টি বিজিবির চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে এই বার্মিজ গরুগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

বছর খানেক ধরে বিষয়টি নিয়ে জেলা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে একাধিকবার আলোচনা সমালোচনার শীর্ষবিন্দু হয়ে আসলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোর কোন পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। চোরকারবারীরা যে যার মতো করে এই অবৈধ গরুর  ব্যবসা করেই যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনগুলোও রহস্যজনক কারণে দায়সারাভাবে রয়েছে। এক সময় গরু পাচারের এই ব্যবসাটি একটি সিন্ডিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন উপজেলাগুলোর সীমান্তবর্তী পরিবারগুলো দিন দিন অবৈধ গরু পাচারের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। যাদের পরিবারে এক সময় নূন আনতে পানতা ফুরিয়ে যেতো তারা এখন লাখ লাখ টাকা গুনছে এবং স্বপ্ন দেখছে কোটিপতি হওয়ার। এরকম শত শত নব্যধনী ব্যক্তির উদয় হয়েছে উপজেলাগুলোতে। জড়িয়ে পড়েছেন অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরাও। তাদের সাথে চকরিয়া ও রামু উপজেলার অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও জড়িয়ে পড়েছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় গরুর ডিপোও তৈরি করেছেন বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলেন,এই অবৈধ গরুর সাথে ইয়াবা অস্ত্রও আসছে। কারণ বিগত সময়ে সেনাবাহিনী, বিজিবি , র‌্যাব ও পুলিশের হাতে অনেক ইয়াবা ব্যাবসায়ি বড় বড় চালান নিয়ে ধরা পড়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রথম ২০০১ সালে কালুরঘাট ব্রীজে লেবুর গাড়িতে যে একে-৪৭ অস্ত্র পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলো সেই অস্ত্রটিও মিয়ানমার আলীকদম ও লামা হয়ে পাচার করেছিল চোরাচালান সিন্ডিকেট।

সম্প্রতি আলীকদম ও নাইক্ষংছড়িতে গরু পাচার করার সময়ে চোরাচালানীদের সাথে বিজিবির গুলাগুলিতে আলীকদমে ১জন ও নাইক্ষংছড়িতে দুজন নিহত ও অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছিল। সম্প্রতি সময়ে আলীকদমে এক সাংবাদিক গরু পাচারের ছবি তুলতে গেলে তাকে মেরে আহত করে এবং তার মোবাইল ও ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলে দেয় চোরা চালান সিন্ডিকেটের সন্ত্রাসীরা।

এভাবে অবৈধ পথে গরু প্রবেশ হওয়াতে একদিকে দেশীয় খামারীরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে বছরে প্রায় শতকোটি টাকার রাজস্ব। তবে এই অবৈধ গরু পাচার প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া কোন প্রকারেই সম্ভব নয় বলে জানান স্থানীয় সচেতন মহল। এই গরু পাচারে আলীকদম ও লামা থানার সরাসরি হস্তক্ষেপ রয়েছে এবং টোকেনের মাধ্যমেই এই গরু পাচার হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে। যদিও থানা দুটির ওসি বিষয়গুলো অস্বীকার করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লামা উপজেলার এক গরুর খামারী বলেন, আমরা দেশীয় খামারীরা নিঃস্ব হওয়ার পথে। অবৈধ গরু পাচারকারীদের কাছ থেকে প্রতি গরুতে ৩ হাজার টাকা নেওয়া হয় ভালো কথা কিন্তু দেশীয় গরু থেকেও দিতে হবে কেন। দেশীয় গরু থেকে যদি না দিলে গাড়িটা কিছুদূর গেলে পুলিশ দাঁড়ানো থাকে এবং তারা বার্মিজ গরু বলে তকমা দিয়ে জব্দ করার চেস্টা করে। তখন ৩ হাজার টাকা হয়ে যায় ৫ হাজার। নিরূপায় হয়ে টাকা দিতেই হয়।

অন্য এক গরুর খামারী বলেন, এই অবৈধ গরু পাচারের টাকাগুলো তোলার জন্য থানা থেকে একজন ক্যাশিয়ারও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও এই গরুর টাকা সমন্বয় করতে লামা উপজেলার লাইনঝিরি নামক স্থানের চেকপোস্টে বসে থাকে সিভিল ড্রেসে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা কনস্টেবল।

গরু পাচারের বিষয়টি বর্তমানে উপজেলাগুলোর ওপেন সিক্রেট একটি বিষয়। প্রতি সোমবার আসলে মনে হবে লামা-আলীকদম সড়ক যেনো গরু পাচারের ট্রানজিট। সোমবার একদিনেই প্রায় ২ শতাধিক অবৈধ বার্মিজ গরুর গাড়ি বের হয় লামা-আলীকদম সড়ক দিয়ে। আর অন্যান্য দিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ গাড়ি বের হয়। বিষয়গুলো প্রশাসনের নাকের ডগায় হলেও রহস্যজনকভাবে এড়িয়ে চলছেন তারা।

অনুন্ধানে জানা যায়, মাঝে মধ্যে অবৈধ গরু সিন্ডিকেটের দুই এক গাড়ি গরু জব্দ করার জন্য নিজেরাই ধরিয়ে দেয়। তারপর শুরু হয় লোক দেখানো নিলাম। পরে তাদেরকে ভ্যাট ট্যাক্সের কাগজ দেওয়া হয়। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এই দুই এক গাড়ির কাগজপত্র দেখিয়ে প্রায় কয়েকশ গাড়ি গরু পাচার করা হয় একই সড়ক দিয়ে।

এই অবৈধ বার্মিজ গরুগুলো মুলতঃ আলীকদম ও নাইক্ষংছড়ির বিজিবি চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে দেশে প্রবেশ করে এবং অসংখ্য গভীর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে এসে গাড়িতে তোলা হয়। তারপর আলীকদম, লামা ও চকরিয়া সড়ক দিয়ে বের হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যায়। তাছাড়াও নাইক্ষংছড়ি সীমান্তের গরুগুলো নাইক্ষংছড়ি, রামু ও চকরিয়া উপজেলা দিয়ে বের হয়। আবার আলীকদম থেকে লামা হয়ে পাচার হওয়ার বিভিন্ন উপ-সড়কও রয়েছে, যার মধ্যে রূপসী পাড়া, ফাইতং, লাইনঝিরি, ইয়াংছা হয়ে সুরাজপুর-মানিকপুর সড়ক, ফাঁসিয়াখালী, রংমহল, হারগাজা এবং চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট ও ডুলাহাজেরা ইত্যাদি সড়কগুলো উল্লেখযোগ্য।

মাঝে মধ্যে পুলিশ ও বিজিবি কর্তক লোক দেখানো কিছু গরু আটক করলেও চোরা চালান সিন্ডিকেটের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে সরকারকে যথাযথ কর না দিয়ে নিজেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে নেয়। এই গরু পাচারের টাকা লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। তাছাড়াও উপজেলাগুলোর বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায়ও বেশ কিছু টাকা লেদেনে খবর পাওয়া গেছে।

লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল বলেন, বিষয়টা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়েও আলোচলা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা  প্রয়োগকারী সংস্থাকে এই গরু পাচার বন্ধ করার জন্য বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে লামা সার্কেলের এএসপি আনোয়ার হোসেনের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। বিজিবির সিও এবং আলীকদম থানার ওসির সাথে কথা বলতে বলে তিনি ফোন কেটে দেন।

বিজিবির সিও রেজাউল করিম বলেন, “আমাদের বক্তব্য দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে আপনারা দেখতেই তো পাচ্ছেন আমরা বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করছি।“