হামলা কেউ দেখেনি, তবুও মামলা-গ্রেপ্তার

মানবজমিনের সৌজন্যে ডেস্ক রিপোর্ট :: সংঘর্ষ হয়েছে এমন দৃশ্য দেখেনি এলাকার কেউ। ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শুনেনি। ছিল না সভা-সমাবেশের পূর্বঘোষিত কোনো কর্মসূচিও। তারপরও হামলা-বিস্ফোরণের অভিযোগে দায়ের হচ্ছে একের পর এক গায়েবি মামলা। বিরোধী নেতাকর্মীদের করা হচ্ছে গ্রেপ্তার। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা রাজধানীর শ্যামপুর এলাকায়। সরজমিন গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলার বিষয়টি জানতে চাইলে যেন আকাশ থেকে পড়েন জুরাইন কবরস্থান এলাকার চা দোকানি মোসলেম উদ্দিন।

সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ জানান, বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানেই ছিলাম। জুরাইন কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি কারোরই কোনো সভা-সমাবেশ হয়নি। হামলা তো দূরের কথা। ওইদিন এলাকায় কোনো পুলিশও আসতে দেখিনি।
একই কথা বললেন স’মিল শ্রমিক মোজাফফর হোসেন। শুধু মোসলেম কিংবা মোজাফফর নন, স্থানীয় আরও ৫-৬ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। কেউই ১৮ই অক্টোবর সন্ধ্যায় হামলা-বিস্ফোরণ কিংবা গ্রেপ্তারের বিষয়টি দেখেননি। কথা হয় জুরাইন ৫৪নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ কর্মী মানিকের সঙ্গে।

তিনিও স্বীকার করলেন, বুধবার জুরাইন এলাকায় আওয়ামী লীগের কোনো সভা-সমাবেশ হয়নি। তারপরও গত ১৮ই অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যায় জুরাইন কবরস্থান সংলগ্ন ময়লার ডাম্পিংয়ের ফাঁকা জায়গায় আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে মামলা করা হয়। ১৯শে অক্টোবর রাজধানীর শ্যামপুর থানায় মামলাটি করেন শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সদস্য শাহাদাত হোসেন। মামলায় ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৪০-৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক আবু নাঈম মো. সাইফুল ইসলামকে। বাকি যে ৩৮ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই ঢাকা মহানগর বিএনপি’র পদধারী নেতা।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১৮ই অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শ্যামপুর থানার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের একটি কর্মিসভা জুরাইন কবরস্থান রোড ৩নং গেটের সংলগ্ন ময়লার ডাম্পিং এর পাশে ফাঁকা জায়গায় অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সভা চলাকালীন সময় স্থানীয় বিএনপি নেতা হাজী আবু নঈম মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (৪৭) এর নেতৃত্বে বিএনপি ও তার অঙ্গ-সংগঠনের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা বেআইনিভাবে জনতাকে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে লাঠিসোটা ও ককটেল বোমা নিয়ে সজ্জিত হয়ে আওয়ামী লীগের সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণের ওপর অতর্কিত হামলা করে। ওই সভায় বিএনপি ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা অতর্কিতভাবে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র লাঠিসোটা দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণকে মারধর করতে থাকে এবং অতর্কিতভাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। মারধরের একপর্যায়ে বিএনপি ও তার অঙ্গ- সংগঠনের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে থাকা ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। হামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণ গুরুতর আহত হন।

ঘটনার সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আহতদের উদ্ধার করেন। এ সময় মো. মিজানুর রহমান (৩০), মো. সাদিক হোসাইন (৩৫), মো. ফরহাদ হোসেন (৩২), আশরাফুল ইসলাম শুভ (৩০) এবং সমিউর রহমান খান ওরফে দীপু খান (৪৩)কে গ্রেপ্তার করেন। অন্যরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৪টি বিস্ফোরিত ককটেল, জর্দার টিনের কৌটা, লোহার রড ৩টি, ৫টি কাঠের লাঠি উদ্ধার করে।

একইদিন একই সময়ে একই ধরনের হামলার অভিযোগে কদমতলী থানায় ৬৭ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেন সাবিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। যে ৬৭ জনকে আসামি করা হয়েছে তারা সবাই বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওদিকে ২২শে অক্টোবর একই ধরনের হামলার অভিযোগে শ্যামপুর থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। মামলায় আসামিও করা হয়েছে একই ব্যক্তিদের।

শ্যামপুর থানায় দায়েরকৃত মামলার এক নম্বর আসামি আনম সাইফুল ইসলাম বলেন, মামলায় যে স্থানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিই ছিল না। এ ছাড়া ১৮ই অক্টোবর বিএনপি’র সমাবেশ শেষে রাত ৯টা পর্যন্ত নয়াপল্টন কার্যালয়ে ছিলাম। আমার সঙ্গে মামলায় উল্লিখিত নেতারাও ছিল। মামলার এজাহারে যাদের নাম আছে তাদের সবাইকে আমি চিনি। কিন্তু যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এই নামে শ্যামপুরে বিএনপি’র কোনো নেতা নেই।

মামলার আরেক আসামি স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ও শ্যামপুর থানার সাবেক সভাপতি নাছির আহম্মেদ বলেন, ১৮ই অক্টোবর বিএনপি’র সমাবেশ শেষে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নয়াপল্টন কার্যালয়ে ছিলাম। ওইদিন এলাকায় হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। সম্পূর্ণ মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় আমাদের আসামি করা হয়েছে।

শ্যামপুর থানার ৫৪নং ওয়ার্ড যুবদলের আহ্বায়ক মনির হোসেন বলেন, ১৮ই অক্টোবর পারিবারিক কাজে আমি নারায়ণগঞ্জে ছিলাম। রাত ৯টার দিকে ঢাকায় আসি। অথচ আমাকে গায়েবি মামলায় আসামি করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখবেন, আমি জীবনে কাউকে একটা চড়ও মারিনি। অথচ বিএনপি করার কারণে আমার বিরুদ্ধে ২৫টি মামলা করা হয়েছে। সবগুলোই গায়েবি মামলা।

বিএনপি’র তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আগামী ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশকে ঘিরে দায়ের হচ্ছে একের পর এক গায়েবি মামলা। থানা ভিন্ন হলেও কাকতালীয়ভাবে মামলার অভিযোগের ধরন ও হামলার সময় একই দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে যাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে এই নামে বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি।

গায়েবি মামলার বিষয়ে শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনা ঘটেনি এমন অভিযোগ সত্য নয়। ওইদিন হামলার খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা ঘটনার সত্যতা পায়। এরপর মামলাটি আমলে নেয়া হয়। এখন মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে শিগগিরই আমরা আদালতে রিপোর্ট দাখিল করবো।

আনম সাইফুল ইসলামের মামলার আইনজীবী এডভোকেট রুবেল মিয়া বলেন, গত ১৯শে অক্টোবর বিস্ফোরক আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়। ওইদিনই মামলাটি কোর্টে পাঠানো হয়েছে। এটা একটি রাজনৈতিক মামলা। তিনি আরও বলেন, মামলায় যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে, মূলত এমন কোনো ঘটনাই ওইদিন ঘটেনি। এ ছাড়া মামলায় বাদীর বাসার ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়নি। এতেই বোঝা যায়, মামলাটি মিথ্যা।

এদিকে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অভিযোগ করে বলেন, গত সপ্তাহে কেরানীগঞ্জে বিএনপি’র ১৭ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের মামলা দায়ের করা হয়েছে। অথচ যে ১৭ জনের বিরুদ্ধে চুরির মামলা দেয়া হয়েছে তাদের অন্তত ১০ জন সরকারকে বছরে লাখ টাকা আয়কর দেন। বিরোধী দলের আন্দোলন দমাতেই সরকার বিভিন্ন থানায় গায়েবি মামলা দায়ের করছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি একদফা দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন করছে। আমাদের দ্বারা কোথাও অহিংস কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবুও আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে মাত্র ৪ দিনেই ৪৮টি মামলা দিয়েছে। ১৩৬০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা আমাদের হুমকি দিচ্ছে। এটা চরম দুর্ভাগ্যজনক।

আরও পড়ুন