ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার
মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান :: আঠারো সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশ হলো ভূমি সংশ্লিষ্ট অপরাধ ও প্রতিকার আইন। মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ছিল এ আইন। কারণ, কার জমি, কার দখল ইত্যাদি নিয়ে একটা হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে জমিজমা নিয়ে। একজনের জমি আরেকজন দখল করে চাষবাস ঘরবাড়ি সবই করে নিচ্ছে। প্রতিকার পেতে পেতে কোর্টকাচারির প্রাঙ্গণ দৌড়াতে দৌড়াতে জীবন পার। সম্ভবত আদালতে সবচেয়ে বেশি মামলা ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে। আশা করা যায় এ সংক্রান্ত হয়রানি থেকে এ আইন আমজনতাকে সুরক্ষা দিবে।
এ আইনে ভূমি প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ বলতে বুঝানো হয়েছে –ক) অন্যের মালিকানাধীন ভূমি স্বীয় মালিকানাধীন ভূমি হিসেবে প্রচার করা, খ) তথ্য গোপন করে কোন ভূমি, সম্পূর্ণ বা তার অংশবিশেষ, কোন ব্যক্তি বরাবর হস্তান্তর বা সমর্পণ করা, গ) স্বীয় মালিকানাধীন ভূমির অতিরিক্ত ভূমি বা অন্যের মালিকানাধীন ভূমি, তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে, কোন ব্যক্তি বরাবর হস্তান্তর বা সমর্পণ করা, ঘ) কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তি বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বা জ্ঞাতসারে এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তিরূপে প্রতিস্থাপন করে কোনো ভূমি সম্পূর্ণ বা এর অংশ বিশেষ হস্তান্তর বা সমর্পণ করা, ঙ) মিথ্যা বিবরণ সম্বলিত কোনো দলিল স্বাক্ষর বা সম্পাদন করা, চ) কর্তৃপক্ষের নিকট মিথ্যা বা অসত্য তথ্য প্রদান করা। এসব অপরাধ করলে এ আইনানুযায়ী অপরাধী ব্যক্তি অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
এ আইনের অধীনে ভূমি জালিয়াতি সংক্রান্ত অপরাধগুলো হলো- ক) কোন ব্যক্তির ক্ষতি বা অনিষ্ট করার বা কোনো দাবি বা অধিকার সমর্থন করার অথবা কোনো ব্যক্তিকে কোন সম্পত্তি পরিত্যাগ বা চুক্তি করতে বাধ্য করার বা প্রতারণা করা যেতে পারে এমন অভিপ্রায়ে কোন মিথ্যা দলিল বা কোনো মিথ্যা দলিলের অংশ বিশেষ প্রস্তুতকরণ, খ) কোন দলিল বা তার অংশবিশেষ এমন কোন ব্যক্তি কর্তৃক বা তার কর্তৃত্ববলে প্রস্তুত, স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত বলে বিশ্বাস করার অভিপ্রায়ে, যে ব্যক্তি কর্তৃক বা যে ব্যক্তির কর্তৃত্ববলে তা প্রস্তুত, স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত হয় নি বলে সে জ্ঞাত বা অবগত, অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে অনুরূপ দলিল বা তার অংশবিশেষ প্রস্তুত, স্বাক্ষর, সিলমোহর বা সম্পাদন, গ) কোন দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া, অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে, তার কোন অংশবিশেষ কর্তন করা বা অন্য কোন ভাবে তার কোন গুরুত্বপূর্ণ অংশের পরিবর্তন, ঘ) সম্পূর্ণ বা আংশিক কোন মিথ্যা দলিল প্রস্ততকরণ, ঙ) অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে কোন ব্যক্তিকে কোন দলিল স্বাক্ষর, সিলমোহর, সম্পাদনা বা পরিবর্তন করতে বাধ্য করা ইত্যাদি। এসব অপরাধ করলে অপরাধী ব্যক্তি অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
এ আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনের অধীন দায়েরকৃত মামলায় কোন দলিল প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত বা প্রস্তুতকৃত মর্মে প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আদালত ওই মামলার রায় বা আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করে তা প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত বা প্রস্তুতকৃত মর্মে সংশ্লিষ্ট নথি, রেজিস্ট্রার বা রেকর্ডপত্র লিপিবদ্ধ করার আদেশ প্রদান করবেন।
ভূমি হস্তান্তর, জরিপ, রেজিষ্ট্রেশন, রেকর্ড হালনাগাদকরণ বা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোন কার্যক্রমে প্রদর্শিত বা উপস্থাপিত কোন দলিল বা ভূমি সংক্রান্ত প্রতারণা বা জালিয়াতি করা হয়েছে মর্মে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উক্ত বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে তা বিচারের জন্য উপযুক্ত ফৌজদারি আদালতে প্রেরণ করবেন।
এখন থেকে কোন ব্যক্তির নামে ভূমির হালনাগাদ খতিয়ান না থাকলে এবং অনুরূপ খতিয়ান ও হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রমানক প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে তিনি ওই ভূমি বিক্রয়, দান, হেবা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর, পাওয়ার অব এটর্নি সম্পাদন বা দলিল রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবেন না।
সর্বশেষ খতিয়ান মালিক বা তার নিকট হতে উত্তরাধিকার সূত্রে বা হস্তান্তর বা দখলের উদ্দেশ্যে আইনানুসারে সম্পাদিত দলিল বা আদালতের আদেশের মাধ্যমে মালিকানা বা দখলের অধিকার প্রাপ্ত না হলে, কোন ব্যক্তি ওই ভূমি নিজ দখলে রাখতে পারবেন না।
আইনানুগভাবে দখলের অধিকারপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তিকে উপযুক্ত আদালত বা কর্তৃপক্ষের আদেশ ব্যতীত তার দখলীয় ভূমি হতে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত করা যাবে না এবং তাকে ওই ভূমি দখল বা তাতে প্রবেশে বাধা দেওয়া যাবে না। দখল সংক্রান্ত বিধান লংঘন করলে দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থ দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
কোন ব্যক্তির নামে ভূমির সর্বশেষ খতিয়ান না থাকলে এবং অনুরূপ খতিয়ান ও হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রমাণক প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে তিনি ওই ভূমি বিক্রয়, দান, হেবা বা অন্য কোন ভাবে হস্তান্তর, পাওয়ার অব এটর্নি সম্পাদন বা দলিল রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবেন না।
অবৈধভাবে দখলচ্যুত ব্যক্তির দখল পুনরুদ্ধার বিষয়ে বিধান হল-কোনো ব্যক্তিকে উপযুক্ত আদালত বা কর্তৃপক্ষের আদেশ ব্যতীত তার দখলীয় ভূমি থেকে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত করা হলে, তিনি দখল পুনরুদ্ধার করতে সংশ্লিষ্ট অধিক্ষেত্রের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আবেদন করবেন।
এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে আইনানুগ প্রক্রিয়া ব্যতীত উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত করা হয়েছে মর্মে সন্তুষ্ট হলে, তাকে তার পূর্ব দখলীয় ভূমিতে পুনর্বহাল করতে যথাযথ আদেশ প্রদান ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ ও সরেজমিন তদন্ত করতে হবে। যথাযথভাবে নোটিশ জারির পরও কোন পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপস্থিত থাকলে সরেজমিন তদন্ত ও প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করার পরে লিখিত আদেশ দিবেন। বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত মূল্যের সম্পূর্ণ অর্থ বিক্রেতাকে পরিশোধ করা সত্ত্বেও যদি বিক্রেতা যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত, ক্রেতাকে ভূমির দখল হস্তান্তর না করেন তাহলে বিক্রেতা ২ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ভূমির সীমানা বা সীমানা চিহ্নের ক্ষতি সাধন করেন বা এমন কোন কাজ করেন যাতে উক্ত ভূমি বা তাতে অবস্থিত স্থাপনা, বৃক্ষ বা ফসলের কোন ক্ষতি সাধন হয়, তাহলে অপরাধী ২ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থ দন্ডে দন্ডিত হবেন।
অবৈধভাবে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্বার্থযুক্ত বা জনসাধারণের ব্যবহার্য কোন ভূমি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ভরাট করে তার শ্রেণি বা প্রকৃতি পরিবর্তন করলে ২ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থ দন্ডে দন্ডিত হবেন।
জেলা প্রশাসকের অনুমতি ব্যতীত আবাদযোগ্য বা কর্ষণীয় জমির মাটি কাটলে বা মালিকের বিনা অনুমতিতে জমিতে বালু বা মাটি ভরাট করলে একই দন্ডপ্রাপ্ত হবেন।
সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্বার্থযুক্ত বা জনসাধারণের ব্যবহার্য কোন ভূমি অবৈধভাবে দখল বা তাতে প্রবেশ বা কোন স্থাপনা বা কাঠামো নির্মাণ করে উক্ত ভূমির স্থাপনা, বৃক্ষ বা সীমানা চিহ্নের ক্ষতি সাধন করলে অনুরূপ কারাদণ্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্বার্থযুক্ত বা জনসাধারণের ব্যবহার্য কোন ভূমি অবৈধভাবে দখল বা তাতে প্রবেশ বা কোন স্থাপনা বা কাঠামো নির্মাণ করে উক্ত ভূমির স্থাপনা, বৃক্ষ বা সীমানা চিহ্নের ক্ষতি সাধন, মাটি ভরাট, ভূমির উপরিস্তর কর্তন, শ্রেণি পরিবর্তন ইত্যাদি পুনরুদ্ধার বা পুনঃস্থাপনে জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যথাযথ আদেশ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। এ আদেশ অমান্য করলে ২ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থ দন্ড – এ উভয় শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা বা ইন্ধনকারী বা সহায়তাকারী অনুরূপ দন্ডে দন্ডিত হবেন। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে।
এ আইনের অধীন মামলা আমলযোগ্য অপরাধ। এর মধ্যে ভূমি সংক্রান্ত প্রতারণা ও জালিয়াতি অ-জামিনযোগ্য। অন্যান্য অপরাধ জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য অপরাধ।
এ আইনের অধীন কোন অপরাধ সংগঠনকারী ব্যক্তি কোন দেশি-বিদেশি কোম্পানি বা ফার্ম হলে, তা বাংলাদেশে নিগমিত হোক বা না হোক কোম্পানির মালিক, পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ অপরাধের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী হবেন যদি না তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে এ অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে বা তিনি অপরাধ রোধ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এর বিচার হবে এবং তা ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে।
অপরাধের শিকার হওয়ার কারণে আদালতের কাছে ক্ষতি পূরণ ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে। এ আইনের অধীন বিচারকালীন যদি আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে উপযুক্ত ব্যক্তির অনুকূলে দখল অর্পণ করা প্রয়োজন তাহলে আদালত এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পাঠাবেন। আদালত যদি মনে করে সংগঠিত অপরাধের কারণে কোন ব্যক্তি বা সংস্থা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাহলে আদালত অপরাধীর নিকট হতে ক্ষতিপূরণ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রদানের আদেশ দিতে পারেন।
ফৌজদারি আদালত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে স্বীয় বিবেচনায় বিচারাধীন মামলার বাদী বা কোন স্বাক্ষীকে নিরাপত্তা বা সুরক্ষা প্রদানে প্রয়োজনীয় আদেশ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধের স্বচ্ছ ও দ্রুত প্রতিকার চাচ্ছিল। এ আইন প্রণয়নের ফলে মানুষেল চাহিদা পূরণ হলো, আবার দুর্বৃত্তদের শৃঙ্খলায় আনার পথ সুগম হলো। আশা করা যায় মানুষ এখন এ সংক্রান্ত অপরাধের দ্রুত সমাধান পাবেন।
লেখকঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ।