মহাপুরুষদের বাণী ’’যে দেশে গুনীর জন্ম নেই, সেই দেশে গুনী জন্মায় না”। এখন এই বাণীকে আমরা কতটুকু আপন করে নিয়েছি তা হবে আমাদের কাজের প্রমাণ। আজ আমাদের নৈতিক চরিত্রের আবক্ষয় হচ্ছে, যুব সমাজ সঠিক পথের সন্ধান পাচ্ছে না, এই সবের মূলে আমরা গুনীর পদাঙ্ক অনুসরণ কেেত পারছি না। কারণ গুনীর সমাদর আজ আমাদের মাঝে নেই। এখন আমাদের মাঝে এসেছে আত্নগৌরব, নিজের গুনে নিজে মহিমান্বিত। সেই শেখ সাদীর ভাষায় বলতে হয়, “দামী কাপড়, দামী গাড়ি হাঁকালেই গুনী হওয়া যায় না। দেশ ও জাতির জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারলেই আপনার গুনে দেশ মহিমান্বিত হবে।“ উত্তরসুরীরা আপনার পদানুসরণ করে দেশকে দ্রুত উন্নতির শিখরে তুলতে পারে। এমনই করে দেশ ও জাতির জন্য যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা এই বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টলার ব্যাক্তিত্ব শেখ-ই-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার। আজ ১১ আগস্ট, সেই জীবন উৎসর্গকারী সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদের ১৬৯তম জন্মবার্ষিকী। সেই কাজেম আলী মাস্টার কে? তিনি কেন গুনী ব্যক্তিত্ব। কিংবা তার পরিচয় আজকের যুব সমাজ তা ভাল করে জানেন বলে আমার মনে হয় না। কারন ১৬৯তম জন্মবার্ষিকী পালন করছি কিন্তু তার পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনী যুব সমাজের হাতে তুলে দেয়ার মত কোন ব্যবস্থা আমাদের বুদ্ধিজীবীরা গ্রহন করেন নি। যার ফলে বর্তমান বুদ্ধিজীবীরা তাদের মৃত্যুর পর তিনি আর অমর হয়ে থাকার কোন ব্যবস্থা থাকবে না।মহাপুরুষদের জীবনী ধরে না রাখার কারণে আমরা আজ সেরুপ অগ্নিপুরুষ পাচ্ছি না। ইতিহাস সত্য কথা বলে। ইতিহাস আমাদের অপরাধের জন্য আমাদের দায়ী করবে। ইতিহাস ক্ষমা করতে জানে না। তাই ক্ষমাও হবে না। আজ যদি এরুপ ব্যক্তিত্বকে আমরা যুব সমাজের কাছে পরিচয় করে দিতে পারতাম তাহলে আমাদের দেশ আজ সোনার বাংলাদেশে পরিনত হতো। আমাদের যুবসমাজ হতো সভ্য সমাজ। তাই আসুন আজ আমরা সেই কাজেম আলী মাস্টারের আংশিক কর্মময় রাজনীতি জীবন, সামাজিক জীবন ও তার ব্যাক্তিত্ব ও পরিচয় নিয়ে আলোচনা করি।
’’শেখ-ই-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার” চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের একজন দেশ বরেন্য কৃতি সন্তান, এই উপমহাদেশের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। শেখ ই চাটগাম নামে সুপরিচিত।এই কোন তার পিতা মাতার দেয়া নাম নয়। বংশ পরিচিতিও নয় এটি তার ব্যক্তিত্বের উপাধি। আবার এটি কোন সরকার বা রাজ-রাজার প্রদত্ত্ব উপাধি নয়, সুদীর্ঘ কর্মজীবনে সেবা ধর্মের এক মহাপ্রতিভা হিসেবে তিনি যে আত্মদান করেছেন তার স্বীকৃতির এক অমুল্য প্রতিদান দেশবাসীর দেওয়া উপাধি ’শেখ ই চাটগাম’।
কাজেম আলী মাষ্টারের জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে যখন আমরা পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো চোখ বুলাই তখন দেখি তার জন্ম এক মহা বিভিষিকাময় পরাধীনতার অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে।সমগ্র দেশ জুড়ে ছিল ইংরেজ রাজশক্তির ত্রাসের রাজত্ব। গোটা জাতি ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাধ্য। ১৮৫২ সালের ১১ আগষ্ট চট্টগ্রামের ফরিদাপাড়াস্থ এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম।
তার জীবন আলেখ্য জানতে হলে তৎকালীন ভারতবর্ষে বৃটিশ রাজত্বের সম্পূর্ণ ইতিহাস, যেহেতু কাজেম আলী মাস্টারের সারাটি জীবন ছিল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে সমাজ সেবা ও সর্বোপরি পরাধীনতার বন্ধন মুক্ত করে দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা।
কাজেম আলীর পিতার নাম মুন্সি কাছিম আলী। তিনি তৎকালীন উকিল পরে মুন্সেফ ছিলেন।তিনিও ছিলেন স্বাধীনচেতা ব্যাক্তি। উকালতির আয়ও ছিল খুব ভাল। লোকে তাকে ’বীরপুরুষ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ ’তালুক ভুবন মোহন’ এর মালিক হয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফরিদা পাড়ায় তার নিবাস বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শেখ ফরিদ চশমা (রাঃ) এই পাড়ার স্থপয়িতা বলে অনুমান করা হয়। তারা শেখ ফরিদ (রঃ) এর বংশধর।
কাজেম আলীর বাবারা ছিলেন তিন ভাই। ১. কাছিম আরী, ২. উজির আলী, ৩. আক্কেল আলী। উজির আলীর কর্মজীবর তদন্তে পাওয়া যায় তিনি সেনা বিভাগের একজন সুবেদার ছিলেন। পরে আধ্যাত্বিক সাধনায় মগ্ন হয়ে দরবেশ সেজে সংসার ত্যাগী হন। বর্তমানে দক্ষিন বাকলিয়ায় (মাস্টার পুলস্থ) কাজেম আলী মাস্টার ভিটায় তার মাজার শরীফ বিদ্যামান। স্থানীয় মুরব্বীদের কাছ থেকে জানা গেছে তিনি একজন সাধুবেশে দরবেশ সারাক্ষন আধ্যত্মিক ভাবনায় মগ্ন থাকতেন। তিনি ছোট শিশূদের খুবই আদর করতেন। শিশু দেখলেই সামনে স্তুুপকৃত মাটি থেকে এক টুকরো মাটি হাতে নিয়ে মিসরি করে তা শিশুদের হাতে দিতেন। তিনি গভীর রাতে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরতে অনেকের দৃশ্যমান হয়েছে। অপরজন আক্কেল আলী অকালে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি মুক্তারি পাশ করেছিলেন। কাজেম আলীর বয়স যখন নয়মাস তখনই তিনি মাতৃহারা হয়ে চাচা উজির আলীর স্নেহে পালিত হন। পিতার সংসার থাকলেও তিনি চাচার দায়িত্বে বড় হন।ভারতে ব্রিটিশ রাজ্য শুরুর প্রায় একশ বছর পর্যন্ত মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষার প্রতি ভীতশ্রদ্ধ ছিলেন। শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে থেকে তারা আবার ইংরেজী শিক্ষা গ্রহনে প্রবৃত্ত হন।
কাজেম আলীর মক্তবে পড়া শেষে স্কুলে দেয়া হল। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। পিতা তাকে স্কুলে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ”আমি আর স্কুলে যাব না” তখন পিতা রাগের মাথায় তাকে হালচাষ করতে নির্দেশ দিলে তিনি সত্যিই হালচাষ করতে গেলেন। পরে যখন জানা গেল যে স্কুলে অন্যান্য ছেলেদের আচরণ তিনি সহ্য করতে না পেরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছেন। তখন পিতা তার এমন কারণে তাকে হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের হুগলী শহরে পাঠিয়ে দেন।সেখানে তিনি আধুনিক শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। মুসলমানদের জন্য তখন হুগলীর শিক্ষায় ছিল ভাল। হুগলী থেকে কাজেম আলী এন্ট্রাস পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। শুরু করেন সংস্কৃতমন নিয়ে কর্মময় জীবন। প্রথমে তিনি সাতকানিয়ায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি সেখানে বেশীদিন থাকলেন না। দেশকে তিনি জাগিয়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেন অন্তরে এবং মনস্থ করলেন শহরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবেন। শিক্ষিত হবে জনগন ও দেশ।
১৮৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের দক্ষিন পাশে হযরত মৌলানা মিসকিন শাহ (রাঃ) এর মাজারের পূর্বপাশে জমি খরিদ করে স্থাপন করলেন চিটাগাং মডেল ইংলিশ স্কুল। এর আগে স্কুলটি চকবাজারস্থ অলিখাঁ মসজিদের পশ্চিম পাহাড়ে অবস্থিত ছিল বলে জানা যায়। স্কুলটি সুন্দর পরিবেশে পারিবারিক কায়দায় চলতে লাগল। কাজেম আলী ও তার ভাইয়েরা এই স্কুলের শিক্ষক এবং কাজেম আলী প্রধান শিক্ষক হলেন। এই স্কুলে গরীব ছাত্রদের সুবিধার জন্য ছিল স্বল্প বেতনের ব্যবস্থা, তা না দিতে পারলেও নাম কাটা যেত না। বিনা বেতনের ছাত্র ছিল খুব বেশী। সেময় কাজেম আলী সপরিবারে দক্ষিন বাকলিয়ায় স্থানন্তরিত হয়ে এল। যে বাড়ি বর্তমানে কাজেম আলী মাস্টারের স্মৃতি বহন করে ঐতিহ্যবাহী মাস্টারবাড়ি নামে সুপরিচিত রয়েছে। তার বংশধরগণ এই বাড়িতে বসবাস করছে।
১৮৮৮ সালে এই স্কুলের পাশেই প্রতিষ্ঠিত করলেন চিটাগং হাই স্কুল। তার জীবদ্দশায় অনেক চেষ্টা করেছিলেন কাজেম আলী মাস্টারের নামে এই স্কুলের নাম রাখা কিন্তু ব্যর্থ হলেন সবাই। তার মৃত্যুর পর এই স্কুলের নতুন নামকরণ করা হলো ১৯২৮ সালে কাজেম আলী হাই স্কুল।
কাজেম আলী ছিলেন তেজী, স্বাধীনচেতা এবং সাম্রাজ্যবাদের আপোষহীন সোচ্চার সংগ্রামী নেতা। ১৮৯৩ সালে কাজেম আলী চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে ছিলেন। পৌরসভা বর্তমান সিটি কর্পোরেশন তাকে স্মরণ রাখেন নি।
১৯০৩ সালে বৃটিশ সরকার কাজেম আলীকে খাঁন বাহাদুর উপাধি দানের চেষ্টা করলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। জনসেবার নিঃস্বার্থ কর্মী হিসেবে”কায়সার ই হিন্দ” গোল্ড মেডেল ও সার্টিাফকেট অফ অনার প্রদান করা হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক ভাবে দানা বাধেঁ। এই সময় থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে বৃটিশ বিরোধী ভুমিকায় অংশগ্রহন করে। অত্র অঞ্চলে স্বদেশী আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন। এই সময় তিনি ভারতের বিশিষ্ট খ্যাতিমান পুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, চট্টগ্রামের দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন প্রমূখদের সহচর্য লাভ করেন।
১৯৭৭ সালে সম্রাট ৫ম জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠানে তাকে ২য় বারের মত ’কায়সার ই হিন্দ” উপাধি দেয়া হয়।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ভুমিকায় কাজেম আলী কংগ্রেস মুসলিম লীগ, খেলাফত ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। এসময় তিনি দেশের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন সরূপ সরকারী খেতাব ”কায়সার ই হিন্দ” গোল্ড মেডেল বর্জন করেন।
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কংগ্রেস খেলাফত দুর্বার জাতীয় আন্দোলনে গড়ে তোলার সময় চট্টগ্রাম এক বিশাল সভায় জনতা তাকে ”শেখ-ই-চাটগাম” উপাধি দিয়ে অভিনন্দিত করে। ১৯২১ সালে ধর্মঘট ও শোভাযাত্রা করার অপরাধে অন্যান্য কয়েক নেতার সাথে তিনি কিছুকাল সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করেন এবং এই বছরেই তিনি কংগ্রেসের টিকেটে চট্টগ্রাম থেকে তিনি ভারতীয় আইন পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯২৬ দিল্লীতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করে । অধিবেশনে জোড়ালো বক্তব্য উপস্থাপন করা কালে হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে অধিবেশনে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েন। এই দিন ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। তার মৃত্যু সংবাদে চট্টগ্রাম তথা সারা বাংলাদেশে কালো ছায়া নেমে আসে। তার মৃতদেহ দিল্লীর জাতীয় গোরস্থানে তার নামফলক সারাজীবন অমর হয়ে থাকবে।
চট্টগ্রামের কাজেম আলী হাই স্কুল এন্ড কলেজ, কাজেম আলী রোড়, কাজেম আলী মাষ্টার বাড়ি, কাজেম আলী মাস্টার পুল মরহুমের স্মৃতি বহন করে আছে। চট্টগ্রামের অন্যান্য মনীষী ও বরেণ্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি এই মহান ব্যক্তির নাম স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।