বাঁশখালীতে দেদারসে উজাড় হচ্ছে বন, কাঠ যাচ্ছে অবৈধ করাতকলে

বাঁশখালী উপজেলা বন বীট কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে বাঁশখালী জুড়ে অবৈধ করাতকলের সংখ্যা প্রায় ৮০টি। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের অধীন বাঁশখালী উপজেলার কালীপুর রেঞ্জের আওতাধীন সদর আমিন হাট, পূর্ব বৈলছড়ি, রামদাশ মুন্সীর হাট, গুনাগরি কলেজ রোড, কালীপুরের ছফিরের দোকান, মধ্যম সাধনপুর, পূর্ব সাধনপুর, পূর্ব বৈলগাঁও, বাইন্যা দিঘীর পাড়, গুনাগরি, বনা পুকুর পাড়, চাঁনপুর বাজার, একাইত্তা পুকুর পাড় ও পুকুরিয়া এলাকায় ৩৩টি, বাঁশখালী উপকূলীয় রেঞ্জ (খানখানাবাদ থেকে গন্ডামারা) এলাকায় ১৫ টি, দক্ষিণ বাঁশখালীর জলদী রেঞ্জের আওতাধীন জলদী মিয়ার বাজার, মনছুরিয়া বাজার, শীলকূপ টাইমবাজার, জালিয়াখালী নতুন বাজার, চাম্বল বারিহাঁট, গজার হাট, নাপোড়া উত্তর মাথা, দক্ষিণ মাথা, শেখেরখীল রাস্তার মাথা, উত্তর মাথা, সরকার বাজার, পুইছড়ি বহদ্দার হাট, প্রেমবাজার, সরলিয়া বাজার, সীমান্তবর্তী আরবশাহ বাজার এলাকায় প্রায় ৩০টির অধিকসহ পুরো বাঁশখালীতে অর্ধশতাধিক লাইসেন্স বিহীন অবৈধভাবে স্থাপিত করাতকল দীর্ঘদিন ধরে কলের প্রভাবশালী মালিকগণ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিচালনা করে আসছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের চোখের সামনেই বছরের পর বছর ধরে চলছে এসব অবৈধ করাতকল। ফলে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বন বিভাগের মতে, করাতকল স্থাপনের জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হলেও করাত কলের মালিকরা মানছেন না সেই আইন। ইচ্ছে হলেই খেয়াল-খুশি মতো বসানো হচ্ছে করাতকল। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনও রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাঝে-মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হলেও অবৈধ করাতকল বন্ধে নেয়া হচ্ছে না দীর্ঘমেয়াদি কোনো পদক্ষেপ। এসব অবৈধ করাত কলের ছড়াছড়িতে স্থানীয় অসাধু চক্রের কবলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে বন।
সরেজমিনে বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান সড়কের অদূরে বাঁশখালীর পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলকে ঘিরে ও পশ্চিমে উপকূলী অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে করাতকলগুলো। পাশে রাখা হয়েছে সারি সারি গাছের গুঁড়ি। এমনকি তারা অভ্যন্তরিণ সড়কেই গাছের গুঁড়ি রেখে যাতায়তে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। এসব করাতকলে বনজ বিভিন্ন গাছ রয়েছে। ট্রাক বোঝাই করে আনা হচ্ছে এসব গাছ।
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, ‘হাতের নাগালেই এসব অনুমোদনহীন করাতকল পেয়ে লোকজন গাছ বেশি কাটছে। গাছ হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী উপাদান। এভাবে বেশি বেশি গাছ কাটা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর। সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, অনুমোদনহীন করাত কলগুলো যেন বন্ধ করা হয়। পাশাপাশি চাইলেই যেন করাতকল বসানোর অনুমতি দেওয়া না হয়। অপরদিকে অবৈধ করাতকলের কারণে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিতও হচ্ছে।’
শীলকূপ টাইমবাজারস্থ রাজা মিয়া স’মিল (করাতকল) এর মালিক বদিউল আলম বদু বলেন, ‘কিছুদিন আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন করাতকলগুলোর অনুমোদন নিয়ে চালানোর জন্য। আমরা যত দ্রুত সম্ভব বৈধ কাগজপত্র নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে চাই। কিন্তু এতদিন লাইসেন্স ব্যতীত করাতকল পরিচালনা কেন করেছেন এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক করাত কল মালিকদের কয়েকজন বলেন, ‘স্থানীয় বীট কর্মকর্তারা এসে মাসিক ও বাৎসরিক মোটা দাগের টাকা নিয়ে যায়। অনুমোদন পাওয়ার আবেদন করেও কোন সুরাহা পাচ্ছি না। অনুমোদন না পাওয়ার সুযোগটা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় বীট কর্মকর্তারা নিয়মিত মোটা দাগের টাকা নিয়ে যায়।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অধীন বাঁশখালী উত্তরের কালীপুর বীট কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘উপজেলার কালীপুর রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় ৩৩টি করাতকল আছে, যার মধ্যে একটিরও লাইসেন্স নাই। গত জানুয়ারীতে অবৈধ করাতকলের বিরোদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের জনবল কম তাই অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। বাঁশখালী পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এখানে করাতকল স্থাপনের কোনো বৈধতা নেই। অবৈধভাবে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে। অবৈধ করাত কলের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশ রয়েছে। আমরা এর কপি সংশ্লীষ্ট কতৃপক্ষকে পাঠিয়েছি। এসব অবৈধ করাতকল সরাতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাঁশখালী উপকূলীয় বীট কর্মকর্তা শফিকুল আমিন বলেন, ‘উপকূলীয় খানখানাবাদ থেকে গন্ডামারা এলাকায় প্রায় ১৫টি অবৈধ করাতকল রয়েছে। জলদী রেঞ্জ ও পুঁইছড়ি রেঞ্জের আওতাধীন প্রায় ৩০ টির অধিক অবৈধ করাতকল সহ অর্ধশতাধিক অবৈধ করাতকল রয়েছে। যার কোনটারই লাইসেন্স নেই।’
বাঁশখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর ডিজিএম ঋষি কুমার ঘোষ বলেন, ‘সরকার ঘোষিত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নিমিত্তে লাইসেন্স বিহীন করাত কলের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বরাবর অনুরোধ জানিয়েছি। নির্দেশনা পেলেই অভিযান পরিচালনা করে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ করাত কলগুলো বন্ধে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রয়োজনে ওখানকার সব বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হবে।’

আরও পড়ুন