এসি আকরামের জবানবন্দিঃ ৯৬ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানে টাকাসহ ব্যাংক ডাকাত গ্রেপ্তার

প্রথম প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২১ইং

১৯৮৯ সালের মার্চ মাস। সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা। রাজধানীর ব্যস্ততম বানিজ্যিক এলাকা মতিঝিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে একটি মাইক্রোবাস শরীফ ম্যানসন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অফিস অতিক্রম করে পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে আসতেই একটি প্রাইভেটকার মাইক্রোবাসটির গতিরোধ করে আড়াআড়ি দাড়িয়ে, দ্রুত প্রাইভেট থেকে অস্র হাতে ৪/৫ জন যুবক নেমে পড়ে। এসময় বিকট শব্দে বেশ কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। গোটা এলাকা ধূয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আতংকে মানুষ এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে শুরু করলে মূহুর্তেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। ততক্ষণে প্রাইভেটকার থেকে নেমে ৪/৫ জন সশস্ত্র যুবক মাইক্রোটির ভেতরে থাকা লোকদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টেনে রাস্তায় নামিয়ে মাইক্রোটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সোজা চলতে শুরু করে পল্টনের দিকে। পেছনে পেছনে প্রাইভেট কারটিও মাইক্রোকে অনুসরণ করে চলে যায় দ্রুতগতিতে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া মাইক্রোর যাত্রীগুলো চিৎকার করে বলতে শুরু করে ডাকাত ডাকাত। ততক্ষণে মাইক্রোটি চম্পট দিয়েছে। আর যা কিছু ঘটলো মাত্র ২/৩মিনিটের মধ্যেই।

জানা গেলো মাইক্রো থেকে নামিয়ে দেয়া হতভাগা লোকগুলো গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের চীফ ক্যাশিয়ার, ড্রাইভার ও ক্যাশ পিয়ন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা তুলে গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের ২ নং দিলকুশায় ফেরার পথেই ডাকাতের খপ্পরে পড়ে। তৎকালে প্রকাশ্যে ব্যস্ততম রাস্তা থেকে কোন ব্যাংকের অর্ধ কোটি টাকা লুটের ঘটনা এটাই প্রথম। এরশাদের শাসনামলে প্রকাশ্য দিবালোকে একটি বিদেশী ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনায় পরদিন দেশের সকল সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠে।

আসামি ও প্রতক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনায় এসি আকরাম হোসাইনের জবানবন্দিতে বেসরকারি ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনাটি এরকমই।
রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা ফাটিয়ে ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয়।ওই সময় ঢাকায় কূটনৈতিক পাড়া ছাড়া রাজপথে বা গুরুত্বপূর্ণ স্হানে কোন সিসিটিভি ছিলো না। রাজধানীতে এমন প্রকাশ্য ডাকাতির ঘটনা উদঘাটন পুলিশের জন্য এক মহা চ্যালেন্জ হয়ে দেখা দেয়।

গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসাইন জানালেন, আমাকেই দায়িত্ব দেয়া হয় ক্লু লেস ডাকাতি মামলার রহস্য উদঘাটনের। ঘটনার পর থেকেই ছায়া তদন্ত করছিলেন তিনি। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পাওয়ার পর যেন ডাকাত ধরা কর্তব্য হয়ে যায় তার জন্য।তাই ঢাকাসহ সারাদেশের সোর্সদের মাধ্যমে এই ডাকাতির বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন তিনি। সেই সময় পুলিশ অপরাধের ধরণ দেখে এলাকা ভিত্তিক অপরাধীদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজনদের আটক করে রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করতো। পুলিশ অফিসারদের ফিল্ডে কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা, সোর্সদের তথ্যের সত্যতা, সন্দেহভাজন অপরাধীর কর্মকাণ্ড, গতিবিধি ঘটনার সময় তার অবস্থান, কোন কোন অপরাধীকে ঘটনার পর থেকে এলাকায় প্রকাশ্যে দেখা না যাওয়াসহ পুরনো ডাকাতির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করা হতো। নানা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই মামলার তদন্ত কাজ চালানো হতো। ছিলো না কোন মোবাইল কললিস্ট লিস্ট, কল সনাক্তকরণের যন্ত্রপাতি। শুধুমাত্র অফিসারদের মেধা,বুদ্ধি,দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আর মহান সৃষ্টিকর্তার সহায়তার উপর ভরসা করে পুলিশকে কাজ করতে হতো। এসি আকরাম এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। মতিঝিলের ডাকাতির বিষয়টি তিনি চুলছেড়া বিশ্লেষণ করছিলেন। যেকোন ক্লু লেস মামলার রহস্য উদঘাটনে তার ছিলো দৃঢ় আত্নবিশ্বাস ও মনোবল। তাই গোয়েন্দা পুলিশের জাঁদরেল কাজ পাগল অফিসার এসি আকরাম সর্বদাই ক্লুলেস যেকোন আলোচ্য অপরাধ উদঘাটনে সফল হতেন।এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

ঢাকার অপরাধীদের অপরাধের ধরণ বিশ্লেষণে এমনই এক ডাকাতের তথ্য এলো পুরান ঢাকা থেকে। আর কালবিলম্ব নয় শুরু হলো অপারেশন। হাজারীবাগ গজমহল বস্তি থেকে বাচ্চু নামের ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে অভিযানের যাত্রা শুরু করা হলো। বাচ্চুর দেয়া তথ্যের সূত্র ধরেই গভীর রাত্রেই মোহাম্মদপুরের কাটাসুর বস্তিতে অভিযান চালানো হলো। ডাকাতদের সঙ্গে গোলাগুলির পর জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হলো। তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে একটানা ৯৬ ঘন্টার অভিযানে ঢাকার পলাশির ঢাকেশ্বরি এলাকা থেকে গনি ওরফে কানা খোকাকে আটক করা হয়। তাকে ডিবি অফিসে জেরা করা হয়।এ সময় ঢাকার ফুলবাড়িয়ার পরিবহন শ্রমিক নেতা সুলতান রেজার ভাই হিরু রেজা ডিবি অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করে এই ডাকাতির খোঁজখবরে বেশী উৎসাহ দেখায়। তাই এসি আকরাম গোপনে তার প্রতি নজরদারি বাড়িয়ে দেন। একপর্যায়ে ডাকাতিতে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাকেও আটক করা হয়।এরপর আবারও একটানা অভিযান। ঢাকা, মানিকগন্জ, ফরিদপুর জেলায় অভিযান চালিয়ে সাতজন ডাকাত আটক করা হয়। তাদের স্বীকারোক্তিতে মানিকগন্জ জেলার ঘিউর থানার প্রত্যন্ত চর এলাকার এক ডাকাতের শ্বশুরবাড়িতে ডাকাতির টাকার রাখার তথ্য পাওয়া যায়। শুরু হয় মানিকগন্জের ঘিওরে অভিযান। সেই ডাকাতের শ্বশুড়বাড়িতে কাঠের সিন্ধুক থেকে একটি ব্রিফকেস উদ্বার করা হয়। ওই ব্রিফকেসেই ব্যাংকের স্লিপ লাগানো ডাকাতির ৪৯( উনপঞ্চাশ) লক্ষ নব্বই হাজার টাকাই পাওয়া যায়।উদঘাটিত হয় চাঞ্চল্যকর গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের ডাকাতির রহস্য। পুলিশ প্রশাসনে ফিরে আসে স্বস্তি।

আইনি প্রক্রিয়া ও আদালতের অনুমতিক্রমে গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার ইউনুস সাহেবের হাতে উদ্বারকৃত টাকা বুঝায়ে দেয়া হয় গোয়েন্দা শাখার উপকমিশনারের মাধ্যমে। ডিসি ডিবিই সার্বক্ষণিক মামলাটির মনিটরিং করেন। এসি আকরামের টিমের দুইজন চৌকস পরিদর্শক সুলতান ও শাহজাহান এই অভিযানে নিরলসভাবে কাজ করেন। মূলতঃএসি আকরামের টিম ওয়ার্কই ছিলো তার সাফল্যের চাবিকাঠি। এদিকে ব্যাংকের বিদেশি মালিক পক্ষ ডাকাত আটকে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলো।

এসি আকরাম একটানা চার দিনের এই অভিযানের তৃতীয় দিন রাতে মানিকগঞ্জের চরের কাদা পানিতে হাটার সময় পায়ে একটি বাশের কন্চি ঢুকে গেলে তিনি প্রচন্ড ব্যথায় কাতর হলেও অভিযানে পিছপা হননি। পরে আহত অবস্থায় সাভারের হেমায়েতপুরের রফিক মেম্বরের বাড়ীতে উঠে পা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করিয়েছিলেন। তিনি এখনও জীবিত আছেন। তার সহযোগিতার কথা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে এখনো স্মরণ করছিলেন।তিনি পায়ের আঘাতের সেই ব্যথা অনুভব করেছিলেন জীবিতকালে।

ডাকাত গ্রেফতার, টাকা উদ্ধার ও অভিযান শেষে অফিসে পৌছান চার দিন পর এসি আকরাম।এ সময় এক সপ্তাহ তাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিলো। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত দায়রা জজ মোঃআনিসুজ্জামান ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করেন। গনি ওরফে কানা খোকাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের খালাস দেয়া হয়। এই মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন হিরু রেজা, মোঃরাইস খান, সিরাজুল হক সিরাজ, মোঃ ইয়াসিন, ইউনুস শেখ, ইস্কান্দার, হারুন মীর ও জাহাঙ্গীর। আর ঢাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতদের সাজার মধ্যেমে পুলিশের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো।

আরও পড়ুন