এসি আকরামের জবানবন্দিঃ একটানা ১৭দিনের অভিযানে পুরান ঢাকার শিশু রাজু উদ্ধার
প্রথম প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২১ইং
ঊনচল্লিশ বছর আগের ঘটনা। সালটা মনে থাকলেও দিন তারিখ বা মাস’টি মনে করতে পারছিলেন না এসি আকরাম হোসাইন। তবে হাতে থাকা একটি ছবিই তাকে পেছনের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিচ্ছিলো, তিনি মনে করার চেষ্টা করেছেন ঘটনাটি। ছবিটি দেখে তিনি আবেগপ্রবন হয়ে যান, থেমে থেমে স্মৃতি মনে করছিলেন।
১৯৮২ সালের কথা। তৎকালীন অবিভক্ত লালবাগ থানার ওসি ছিলেন আকরাম হোসাইন। লালবাগ থানার আলী নেকীর দেউরি এলাকা থেকে রাজু নামের দু’তিন বছরের একটি শিশু ছেলেকে অপহরণ করা হয়। বিষয়টি ওই সময় পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়। শিশু অপহরণের মতো নির্মম অপরাধকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। আকরাম হোসাইন এই অপহরণের রহস্য উদঘাটন ও অপহরণকারী চক্রকে আটকে মরিয়া হয়ে উঠেন।
শিশুটির বাড়ি তৎকালিন লালবাগ থানার আলী নেকির দেওরি। তার বাবা চকবাজারে ব্যবসা করেন। তাদের একটি দোকান আছে।শিশুটির পরিবার অপহরণের বিষয়ে নির্দিষ্ট কাউকে সন্দেহ করতে পারছিলেন না। তবে কিছুদিন পূর্বে তাদের দোকানের এক কর্মচারীকে শিশু রাজুর পিতা গালমন্দ করেছিলেন বলে একটি তথ্য দিয়েছিলেন। এরপর কর্মচারী আর দোকানের চাকরিতে আসেননি।এই ক্লু’র সূত্র ধরেই এগুতে থাকলেন পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন। তখন কর্মচারীদের জীবন বৃত্তান্ত বা এনআইডিও ছিলোনা।পরিচিত কেউ দোকানে কাজে লাগিয়ে দিতেন। যে কারনে ওই দোকান কর্মচারীর গ্রামের ঠিকানা তাৎক্ষনিক সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো তার কাছে। এরপরও থেমে থাকেননি এসি আকরাম। প্রথমে যে দোকান কর্মচারী ওই ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলো তাকে খুঁজে বের করা হয়। তার কাছ থেকেই আরো কয়েকজন পেরিয়ে দোকান কর্মচারির গ্রামের ঠিকানা নিয়ে শুরু হয় অভিযান।একটানা ১৭দিন বিরামহীন অভিযান চালিয়ে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানাধীন নিগুয়াইর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর এলাকা থেকে অপহরণকারিকে গ্রেফতার করে তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরেই শিশু রাজুকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন আকরাম হোসাইন।
গ্রামের পর গ্রাম, কখনো কাদামাটির রাস্তা, কখনো শক্ত ইটের ক্লিপিং পথ, কখনো গাড়িতে আবার কখনো পায়ে হেটে চলতে চলতে দিন গড়িয়ে আঁধার নেমে আসে। এভাবেই এসি আকরাম পৌঁছে যায় রাজুকে অপহরণকারীদের আস্তানায়। গ্রামের ঘরের খিল দেয়া কাঠের দরজা নক করতেই খুলে দেন এক নারী। টর্চের আলো ঘরে পড়তেই নজরে আসে শিশু রাজু। যখন শিশু রাজু’র কাছে আমি পৌঁছাই তখন রাত বারটা, বলছিলেন এসি আকরাম হোসাইন। এই উদ্ধার অভিযানের দুইটি স্মৃতি তাকে শিহরিত ও আবেগপ্রবণ করেছিলো।প্রথমতঃ গ্রাম্য টিনের ঘরের ছোট্ট একটি রুমে মাটিতে ধাড়ির বিছানায় ঘুমিয়েছিলো রাজু। দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করেই তিনি পরম মমতায় কোলে তুলে নেন রাজুকে। আবেগপ্লুতো কন্ঠে আকরাম হোসাইন বললেন, আমি তাকে স্পর্শ করা মাত্র সে চোখ খুলে তাকায়।আমি তাকে কোলে তুলে নিতেই সে এমনভাবে ঝাপটে ধরে যার সমান সূক্ষ্ণ অনুভূতি জীবনে দ্বিতীয়বার পাইনি।
সেই আবেগময় স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেননি। শিশু রাজু দুই সপ্তাহের বেশী সময় তার মায়ের আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত। অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত্র ছিলো। তাই আমি তাকে বুকে তুলে নেয়ার পর সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলো নিরাপদ আশ্রয় স্থল ভেবেই। শিশু রাজুকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে তার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত আমার বুক থেকে তাকে একমুহূর্তের জন্যও সরাতে পারিনি। সর্বক্ষণ সে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। দ্বিতীয়তঃ রাত গড়িয়ে সকালে আমরা যখন আলী নেকীর দেউরির মহল্লায় রাজুদের বাসার সামনে পৌছি তখন এলাকার শতশত লোকের ভিড়ছিলো। রাজুকে আমার বুক থেকে যখন তার মা কোলে তুলে নিলো তখন কার আনন্দঘন অশ্রু বিসর্জন সর্বোপরি জনগণের কৃতজ্ঞতাবোধ স্মরণীয় হয়ে আছে ৩৯ বছর ধরে।
১৭ দিন একটানা অভিযানের পর জীবিত অবস্থায় শিশু রাজুকে তার মা-বাবা’র কোলে ফিরিয়ে দেয়ার আনন্দের কথাটি ভুলতে পারেননি তিনি। ৩৯ বছর আগের এই ঘটনার তার জবানবন্দিতে উঠে আসলেও তিনি অপহরণকারী দোকান কর্মচারীর নামটি মনে করতে পারেননি। পরে থানায় জিজ্ঞেসাবাদে অপহরণকারী জানিয়েছিল, শিশু রাজু’র বাবা তাকে বকা দেয়ায় সে প্রতিশোধ নিতেই তার ছেলেকে অপহরণ করেছিলো। বেঁচে থাকলে সেই শিশু রাজু হয়তো আজ ৪১ /৪২ বছরের যুবক। হয়তো সিনেমার গল্পের মতোই তার মা-বাবার মুখে শুনেছেন তাকে অপহরণ ও ১৭দিন মায়ের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ার বেদনাদায়ক গল্প।
এসি আকরাম হোসাইনও আজ বেঁচে নেই, কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পেশাদারিত্ববোধ থেকেই নিজের পরিবার, সন্তান ফেলে নির্ঘুম রাতের পর রাত কাটিয়ে অন্যের সন্তানকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদের পরিবারে মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে পুলিশ বাহিনীকেও মানুষের আস্থার বাহিনী হিসেবে গৌরবান্বিত করে গেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।