গণমাধ্যমের শক্তি ও পেশাদারিত্ব
মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান:: সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের বেশ কিছু রিপোর্ট দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছে। আজীজ-বেনজীর-মিতিউর-আবেদ ঘটনাবলী গণমাধ্যম তুলে ধরে প্রমাণ করেছে এখনো তাদের শক্তি ফুরিয়ে যায়নি। আজীজ-বেনজীরের বিরুদ্ধে লিখতে শতবার চিন্তা করার বিষয় আছে। সম্পাদক-প্রকাশককেও সাতবার পানি খেয়ে মাথা পরিস্কার করার বিষয় আছে যে কি লিখতে যাচ্ছে, কাকে নিয়ে লিখতে যাচ্ছে, কোন্ সাপের মাথায় পা দিতে যাচ্ছে। তারা সেটা করে প্রমাণ করেছে তারা সাংবাদিকতা করতে এসেছে, মুড়ি, লাল চা আর সিগারেট খেতে আসেনি। সাহস বটে!
পাকিস্তানের শোয়েব আক্তারের আগুনে বল মোকাবিলা করা প্রসঙ্গে ভারতের ড্যাসিং ব্যাটসম্যান বীরেন্দর শেবাগ বলেছিলেন, কে বল করছে আমি তা দেখিনা, দেখি বলের গতিপ্রকৃতি। এখানেও সম্ভবত কাকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে সাংবাদিকগণ তা দেখেন নি, দেখেছেন সংবাদের উপাদান।
এর পর আসে মতিউর। রাজস্ব বিভাগে অত্যন্ত প্রভাবশালী জনৈক কর্মকর্তা। একের পর এক থলের বেড়াল বের হতে শুরু করে। একটা প্রবণতা লক্ষ করা গেছে যে যাকে নিয়েই লেখা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই হাজার কোটি টাকার অনিয়মের গল্প বের হচ্ছে। অবশ্য সবগুলো বিষয়ই এখন তদন্ত বা আদালতের এখতিয়ারে। সুতরাং উপসংহার পেতে সময় লাগবে। তবে এ বিষয়গুলো জনমনে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
তারপর আসে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদন তো সাধারণ নিয়োগ প্রার্থীদের চোখ উপরে তুলে দিয়েছে। শুরুতে কর্তৃপক্ষ স্বীকার না করলেও পরে স্বীকার করে নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সর্বশেষ, পিএসসির অনিয়ম নিয়ে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। পিএসসি সৃষ্টির পর থেকে এবারের মত এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি এ প্রতিষ্ঠানকে। পিএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও প্রাক্তন সচিব সাদিকুর রহমান স্যার তো স্বীকারই করেছেন যে ড্রাইভার আবেদকে চাকরিচ্যুত করতে তাঁর খুব বেগ পেতে হয়েছে। পিএসসির বিষয়টাও এখন তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। এর ভবিষ্যৎ কি হবে সময়ই বলে দিবে।
একইভাবে মতিউরের বদলির ঘটনা নিয়ে প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও সচিব বদিউর রহমান স্যার একাধিক মিডিয়ায় মতিউরের শক্তিমত্তার বিবরণ দিয়েছেন। এসবই মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ জানতে পেরেছে।
মিডিয়া তার শক্তিমত্তার আরও একটা উদাহরণ দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কভারেজ দিয়ে। সম্ভবত নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পরে বাংলাদেশ এতবড় স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আর দেখেনি যা তৈরি হয়েছে সপ্তাহের মধ্যে এবং পুরো দেশকে, সরকারকে নাড়িয়ে দিয়েছে, এমনকি আদালতকেও। এ আন্দোলনের শুরুটা ছাত্রদের দিয়ে হয়েছে যেখানে পদধারী কোন নেতা ছিল না। আন্দোলনটা বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। অভিভাবকরা ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন দেয়। সরকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে ছাত্রদের দাবির পক্ষে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে, এগিয়ে আসে সর্বোচ্চ আদালতও। প্রত্যাশার অধিক রায় দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত দেশের সকল মানুষের শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে, যদিও ঘটনার হাইকোর্টের রায় ছাত্রদের রাজপথে টেনে নিয়ে এসেছে। কিভাবে টেনে এনেছে তার প্রমাণ বিজ্ঞ এটর্নি জেনারেল জনাব এ এম আমিন উদ্দিন ইসলাম এর কথায় উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন যে, বিষয়টা নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার। সুতরাং তার সমাধান নির্বাহী বিভাগ থেকে হওয়া উচিত। সরকার ছাত্রদের দাবিতে সমর্থন দিয়ে জনরায় নিজেদের পক্ষে রেখেছে যদিও কেউ কেউ ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা পছন্দ করে নি, বরং ছাত্রলীগও সরকারের মত ছাত্রদের পক্ষে থাকলে সম্ভবত তাদের ইমেজ বাড়তো।
এ আন্দোলন একটা কথা সামনে এনেছে যে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্রদের নিয়মিত সংগঠনের প্রয়োজন নেই। সময়ের দাবিতে ছাত্ররা এমনিতেই তাদের দাবি আদায় করে নেওয়ার বারুদ বুকে ধারণ করে। এক সপ্তাহের মেয়াদে ছাত্ররা পুরো রাজপথ কাঁপিয়ে তুলেছে, সরকার ও আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও সে আন্দোলনে শেষের দিকে ভূত-পেত্নী যোগ হয়েছে। সরকারি সম্পদের এমন বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ যেমন দেশবাসী মেনে নেয়নি তেমনি এতগুলো সম্ভাবনাময় প্রাণের অকাল মৃত্যু দেশের প্রত্যেকটা মানুষকে কাঁদিয়েছে। কী নিদারুণ নিষ্ঠুর বর্বরতা! কাছ থেকে গুলি করে ছাত্র হত্যা!
যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি। গণমাধ্যম এখনো রাষ্ট্র বিনির্মানে শক্তিশালী মাধ্যম – একথা দিবালোকের মতো সত্য। তবে গণমাধ্যমের কিছু পোকা পথ হারিয়েছে এটাও দেখা যায়। গণমাধ্যম দলান্ধ হলে সেটা আর গণমাধ্যম থাকে না, হয়ে যায় দলের লিফলেট। সাধারণ মানুষ সেটা বুঝে। অনেক বড় বড় গণমাধ্যম দলান্ধ হয়ে বা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে, সার্কুলেশন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আলোকে আলো এবং আঁধারকে আঁধার বলতে পারাই গণমাধ্যমের কাজ যদিও বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম এখন কর্পোরেট ঠিকাদার হয়ে গেছে। গণমাধ্যম নতুন করে কয়েকটি শব্দ আবিষ্কার করেছে যেমন মানবিক নেতা, মানবিক আমলা, আশার বাতিঘর ইত্যাদি। নতুন কোন কর্মকর্তা যোগ বা বিয়োগে গণমাধ্যম কর্মীর ফুল নিয়ে ছুটাছুটি বেমানান মনে হয়। আবার কোন নেতা বা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বিশেষ আসরে বিশেষ কারণে গণমাধ্যম কর্মীর বিশেষ যোগদান বা অংশগ্রহণ সাধারণ মূল্যবোধের মধ্যে পড়েনা বলে গণমাধ্যম কর্মীরাই মন্তব্য করেন।
একটা বিশেষ দাবির অবতারণা করা দরকার। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি]’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন মিডিয়াভূক্ত পত্রিকার সংখ্যা ৭০৮টি এবং মোট পত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ২২৭টি। মিডিয়াভূক্ত পত্রিকাগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকেন। মিডিয়াভূক্ত কিছু পত্রিকার সম্পাদক অভিযোগ করেন যে, তারা বছরেও একটা সরকারি বিজ্ঞাপন পান না। এমনকি জেলা পর্যায়ের বিজ্ঞাপনও ঢাকার পত্রিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে তাদের পত্রিকা চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। তারা বিজ্ঞাপন বিতরণ পূর্বের ন্যায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বন্টনের দাবি করেন।
বিভাগীয় পর্যায়ে চাকরির সুবাদে প্রতিদিনই স্থানীয় পত্রিকা দেখতে হয়। তাতে তাদের এ দাবি যৌক্তিক বলে মনে হয়। জেনে হোক না জেনে হোক, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা অধিকাংশ বিজ্ঞাপন ঢাকায় পাঠিয়ে দেন এটা সত্য। আবার বিজ্ঞাপন নিজের হাতে থাকায় কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বশে রাখতে পারার কৌশল নিতে নেওয়ার কথাও শোনা যায় কিংবা যে অফিস বিজ্ঞাপন দেয় সে অফিসের অনিয়ম নিয়ে সাংবাদিকরা কিছু লিখতে চান না। আবার স্থানীয় প্রভাবশালী পত্রিকার বাইরে গিয়ে কর্মকর্তারা অন্য পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন দিতে চান না। কেউ কেউ সাংবাদিকদের দলান্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে বিজ্ঞাপন একটা ফ্যাক্টর বলে মনে করেন। আবার স্থানীয় প্রভাবশালী কোন জনপ্রতিনিধি বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও উপাদান থাকা সত্বেও সংবাদ পরিবেশনে কেউ কেউ নিরবতা পালন করেন। সার্বিক বিবেচনায় তারা ডিএফপি’র মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বন্টনকে ইতিবাচক বলে মনে করেন।
এ বিষয়টা তারা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করতে পারেন, মাননীয় মন্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারেন। পত্রিকার সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করে তারা কেউ কেউ বলেন এতো পত্রিকা দরকার আছে কিনা। কারণ নামধারী পত্রিকা ও নামধারী সাংবাদিক গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীর সুনাম নষ্ট করছে বলে তাদের অভিমত। এ বিষয়টাও মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের নজরে আনা যায়।
যাই হোক, গণমাধ্যম তার শক্তি ও পেশাদারিত্ব নিয়ে এগিয়ে যাক, দেশের কথা বলুক, দেশের সাধারণ মানুষের হোক এ প্রত্যাশা করছি।
লেখক: মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ।
আরও পড়ুন ::
ভূমিকম্প সম্পর্কে আপনি কতটুকু সচেতন
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে শিশুদের অধিকার ও পরিবেশ উন্নয়নের আহবান
আমি বাজের মতই এক ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম—গো অন, চার্জ
গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা : বর্তমান প্রবণতা