যুদ্ধদিনের বীর সেনানী মুহাম্মদ বদিউল আলম

সালেহ বিপ্লব :: ছাত্রজীবনে যে নেতাদের সাহচর্য আমার মতো মাঠকর্মীদের আলোকিত করেছে, তাদের একজন মুহাম্মদ বদিউল আলম। তুখোড় সংগঠক এবং সৎ একজন মানুষ। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক গুণাবলীর কারণে ইউনিয়ন থেকে কেন্দ্র, সব পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, শ্রম ও মেধার বলে আজ তিনি কেন্দ্রীয় নেতা। রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও কিছু নেতার জন্য মনের গভীরে সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লালন করি। মুহাম্মদ বদিউল আলম বিভিন্ন কারণে আমার আদর্শ নেতাদের একজন। তার আর সব যোগ্যতাকে ছাড়িয়ে গেছে ওয়ান ইলেভেনের সময় জীবনবাজি রাখা পারফর্মেন্স।

১৬ জুলাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ বিশেষ দিন। আওয়ামী লীগের জন্য তো অবশ্যই। ২০০৭ সালের এই দিনে ওয়ান ইলেভেন সরকার গ্রেপ্তার করেছিলো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর সত্যিকার অর্থেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তিতে একটা বড়ো ধাক্কা লেগেছিলো। কষ্টকর হলেও সত্য, শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে একটি পোস্টার বের করার সাহস করেননি কোন নেতা। সেই সময় প্রথম যে পোস্টার বের হয়েছিলো, তার কৃতিত্ব মুহাম্মদ বদিউল আলমের। তিনি তখন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। সেই পোস্টার কীভাবে ছাপানো হয়েছিলো, কীভাবে সারাদেশে বিলি করা হয়েছিলো; সেসব ঘটনা শুনলে সবারই আতংকে শরীর শিউরে উঠবে। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি সম্বলিত সেই পোস্টার রিসিভ করতে কতো নেতা অনীহা দেখিয়েছেন আর কারা কারা ঝুঁকি নিয়ে পোস্টার বিলি করেছেন, ইতিহাসে সব লিপিবদ্ধ আছে।
জানা আছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। যাক কারো বিরুদ্ধে বলার জন্য আমার এই লেখা নয়। আমি লিখতে বসেছি প্রিয় নেতা মুহাম্মদ বদিউল আলমকে নিয়ে।

আবারো বলছি, ওয়ান ইলেভেন আমলে জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য যে ঝুঁকি তিনি নিয়েছেন, সে কারণে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরো আরো বেড়ে গেছে। বদি ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় চট্টগ্রামে। আমি তখন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের ছোট একজন কর্মী। কলেজ ছাত্রসংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। পাশাপাশি ১৩ নাম্বার পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।
প্রথম দিন থেকেই মুহাম্মদ বদিউল আলম ভাই আমাকে আকর্ষণ করেন তার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ভিন্নমাত্রায়।

তিনি চট্টগ্রামের সমৃদ্ধ উপজেলা পটিয়ার সন্তান। ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হন স্কুল জীবনেই। ১৯৮৩ সালে তিনি পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের বছর তিনি ছাত্রলীগ পটিয়া কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সাল তিনি পটিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগেও তার মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়েছে। ১৯৮৫-৮৭ মেয়াদে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক, ১৯৮৭-৮৯ মেয়াদে গ্রন্থণা ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং ১৯৮৯-৯১ মেয়াদে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মুহাম্মদ বদিউল আলম।

তৃণমূল থেকে উঠে আসা এ ছাত্রনেতা নিজ যোগ্যতায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও মূল্যায়িত হয়েছেন। ১৯৯২-৯৪ মেয়াদে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ১৯৯৪-৯৮ মেয়াদে সহ-প্রচার সম্পাদক ও ১৯৯৮-২০০২ মেয়াদে শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগের ২০০২ সালের জাতীয় সম্মেলনে তাকে অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। সে সম্মেলনে তিনি ছিলেন অন্যতম নির্বাচন কমিশনার।

ছাত্ররাজনীতির পালা শেষ করে যুবলীগে সক্রিয় হন মুহাম্মদ বদিউল আলম। ২০০৩ সালে তিনি যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

রাজনীতির পাশাপাশি স্কুলজীবন থেকেই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনেও তিনি যুক্ত। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সম্পাদকীয় পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ স্মৃতি সংসদ, শেখ রাসেল স্মৃতি পাঠাগার, শতদল ক্লাব, শুদ্ধ বানান চর্চা, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা খেলাঘর এবং ঢাকাস্থ পটিয়া সমিতিতে তিনি তার সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

পটিয়া আইন কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। পটিয়া সেন্ট্রাল হাসপাতাল লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ও কক্সবাজারের ডিজিটাল হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি সরকার মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অন্যতম পরিচালক এবং এইচ এম এন ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপেকশনের অন্যতম পরিচালক।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মুহাম্মদ বদিউল আলম। ১৯৯৫ সালে সে সময়কার বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গড়ে ওঠা জনতার মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। জনতার মঞ্চের বুলেটিন ও অন্যান্য প্রচারমূলক কাজে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্যবার। প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন। ১৯৯৪ সালের ৩০ এপ্রিল পটিয়া সরকারি কলেজে ছাত্রদলের কর্মীরা তার ওপর হামলা চালায়। রামদা’র আঘাতে তার বাম হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। ওই ঘটনার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দলীয় সভানেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা’র সহায়তায় মাদ্রাজে মুহাম্মদ বদিউল আলমের চিকিৎসা করা হয়।

২০০৫ ও ২০১১ সালে মুহাম্মদ বদিউল আলম পটিয়া পৌরসভা মেয়র পদে নির্বাচন করেন। নেতাকর্মীরা জানান, এলাকায় তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও প্রথমবার সরকারের মেকানিজমে তার বিজয় লুণ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের নির্বাচনে নিজদলের সংসদ সদস্যের চক্রান্তে তিনি বিজয়ী হতে পারেননি।

পটিয়ার (চট্টগ্রাম-১২) সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী সে বারের পৌর নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীকে মদদ দেন। রাজনীতির এ নোংরামিতে পরাজিত হন মুহাম্মদ বদিউল আলম। ফলাফল ঘোষণার পর এলাকার সর্বস্তরের মানুষ তুমুল বিক্ষোভ করে, যার মধ্য দিয়ে আরো একবার মুহাম্মদ বদিউল আলমের জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়।

ছাত্রলীগের পতাকা নিয়ে সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ বদিউল আলম এখন কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলছেন। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১২ পটিয়া আসন থেকে তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। মনোনয়ন না পেলেও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।

ছাত্র রাজনীতির উত্তাল গর্ভে জন্ম নেয়া এই নেতার ভক্ত ও কর্মী-সমর্থকরা আশা করছেন, তার কর্মকাণ্ড ও অবদান বিবেচনা করে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে পটিয়া (চট্টগ্রাম-১২) আসন থেকে মনোনয়ন দেবে। প্রায় দুই যুগের পরিচয় থেকে আমি এটা বলতে পারি, মুহাম্মদ বদিউল আলম একজন সৎ ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। আত্মবিশ্বাসী মানুষ কখনো পরাজিত হয় না, হার মানে না। পটিয়ার নেতা-কর্মী শুভাকাঙ্ক্ষীদের মতো আমিও বিশ্বাস করি, মনোনয়ন পেলে চট্টগ্রাম-১২ আসন থেকে মুহাম্মদ বদিউল আলম বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন।

লেখক : সালেহ বিপ্লব, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

আরও পড়ুন