এসি আকরামের জবানবন্দিঃ নারী পুলিশকে গর্ভবতী সাজিয়ে নার্স মিনতিকে আটকে উন্মোচিত হয় মনির-খুকু উপাখ্যানের রহস্য
প্রথম প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২১ইং
তিন দশকেরও বেশী সময় আগে কথা। ছিলো না কোন বেসরকারি টিভি চ্যানেল, অনলাইন, ইউটিউব চ্যানেল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মূহুর্তেই ছড়িয়ে পরতো না ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার সংবাদ। একমাত্র সংবাদপত্রই ছিলো মানুষের মনের খোড়াক মিটানোর মাধ্যম। মানুষ অপেক্ষায় প্রহর গুনতো কখন সকাল হবে, হকারের মাধ্যমে পত্রিকাটি হাতে পেয়ে দেশে ঘটে যাওয়া নানান সংবাদ জানবে। আর এই অপেক্ষা মূল কারণই ছিলো চাঞ্চল্যকর শারমিন রীমা হত্যা মামলা ও মনির-খুকু উপখ্যান।
ঘটনার সময়কাল ১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাস। ঢাকার অদুরে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে মিজি মিজি গ্রামের খালপাড় থেকে উদ্ধার হওয়া শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দীনের কন্যা শারমিন রীমা খুন হন তারই স্বামী চিকিৎসক দম্পতি মেহেরুন্নেসার বকে যাওয়া সন্তান মনির হোসেন সুরুজের হাতে। সেই সময় দেশের সংবাদপত্রের প্রতিদিনের শিরোনাম হতো রীমা হত্যা মামলা। দেশের আলোচিত সেই মামলায় রীমা হত্যার কারণ অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে মনিরের জীবনে বহু নারীর রঙ্গ লীলার নানান অধ্যায়। আর মনিরের জীবনের রঙ্গলীলার পর্দা ফাঁস হয়েছিলো তৎকালীন ডিবির এসি আকরাম হোসাইনের হাতে নার্স মিনতিকে আটকের মাধ্যমে।
মিনতি ছিলো মনিরের মা মেহেরুন্নেসার ক্লিনিকের নার্স। এসি আকরাম হোসাইন বলছিলেন, সেই নার্স মিনতি ও খুকুকে আটকের কথা। মনিরকে ডিবি কার্য্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পরই ডিবি কর্মকর্তারা তার নয়াপল্টনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বিক্রির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালায়। সেখান থেকে একটি ছবির এ্যালবাম উদ্ধার করা হয়। সেই এ্যালবামে মনির-খুকুর বহু অন্তরঙ্গ ছবি পাওয়া যায়। শুরু হয় এই খুকুকে আটকের অভিযান। খুকুর ঘনিষ্ঠ মনিরের ম্যানেজার জনৈক আজিজকে দিয়ে খুকুর বাসার ল্যান্ড ফোনে বলা হয় তার সঙ্গে জরুরি দেখা করার কথা। খুকু তখনো জানতো না মনিরের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কথা ডিবি জেনে গেছে। থাকতেন ইউনিভার্সিটি এলাকায়। বাসা থেকে বহুল আলোচিত কালো সানগ্লাস পরেই বের হন খুকু। আগেই এসি আকরামের দলটি সেই এলাকায় সিভিল পোশাকে ওৎপেতে ছিলো। খুকু ইউনিভার্সিটি স্টাফ কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় আসতেই তাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে ডিবি পুলিশের গাড়িতে তুলে নেয়া হয়।
ডিবি অফিসে ব্যাপক জিজ্ঞাবাদে খুকু বলতে শুরু করেন, মনিরের সঙ্গে তার পরকীয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনী। বের হয়ে আসে মনিরের মায়ের ক্লিনিকের নার্স মিনতির কথাও। এবার মিনতিকে আটক করতে ডিবি পুলিশের একজন মহিলা অফিসার সম্ভবত হোসনে আরাকে গর্ভবতী রোগী সাজিয়ে মেহেরুন্নেসার গ্রীণ রোডের ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। গর্ভবতী না হয়েও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন নারী অফিসার হোসনে আরা। ক্লিনিকের গেটে রোগীর অবস্থা মুর্মূষ, ব্যাথায় কাতরানোর দক্ষ অভিনয়ে ক্লিনিকের ভেতর থেকে সাদা নার্সিং পোশাকে বের হয়ে আসেন নার্স মিনতি। নেমপ্লেটে নাম দেখে তাদের আর চিনতে বাকি ছিলো না সেই কাংখিত শিকার তাদের হাতের মুঠোয়। মূহুর্তেই রুপ বদলে নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে আসা হয় মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে।
নার্স মিনতি মনিরের নানা কুকর্মের কাহিনী ও খুকুকে তাদের ক্লিনিকে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বের হতে শুরু হয় ডাঃ আবুল কাশেম- ডাঃমেহেরুন্নেসা দম্পতির বকে যাওয়া আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা নেয়া সন্তান মনিরের নারী ঘটিত নানান কাহিনী। দেশের সংবাদপত্রগুলোর বিক্রির সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। তাই প্রতিদিন ডিবি অফিসে সাংবাদিকদের আড্ডা বেড়ে গিয়েছিলো। সারা দেশে মনির-খুকুর রোমাঞ্চকর কাহিনী খাওয়ানো হতো পত্রিকা পাঠকদের। এসি আকরাম হোসাইন সেই সময়ের দৈনিক বাংলার বাণী’র ক্রাইম রিপোর্টার শংকর কুমার দে, ইত্তেফাকের জাকারিয়া মিলন, দৈনিক বাংলার সুনীল ব্যানার্জী, দৈনিক খবরের সেলিম, আজাদের মাঈনুদ্দীন ও সংবাদের বশির সাহেবদের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
ওই মামলায় নিম্ন আদালতে মনির-খুকুর ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খুকুকে খালাশ দিয়ে মনিরের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখলে আইনী সকল প্রক্রিয়া শেষে মনিরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে মনির খুকুর আলোচিত কাহিনী। পরকিয়ায় গৃহবধূ রীমার নির্মম হত্যার কালো অধ্যায়।