কক্সবাজারের শুটকি : অর্থনীতিতে অবদান, পর্যটনের প্রসার, হচ্ছে কর্মসংস্থানও

‘‘যে ক টিঁয়া পাই, তা দি আঁর সংসার ন চলের। অ বাজি, তোঁরা এককানা আঁর মালিকরে ক-না আঁর বেতন বাড়াই দিবার লাই। তা-ইলে এককানা ভালগরি চলির পারির’’ (যে টাকা পাই, তা দিয়ে আমার সংসার চলে না। বাবাজি, তুমি আমার মালিককে একটু বল আমার বেতন বাড়াতে। তাহলে ভাল করে চলতে পারবো)।

কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুটকি পল্লীর নারী শ্রমিক শাহরাজ বানু। কথাতো নয় যেন কলিজা ফেটে নিংড়ে দেওয়া কোন আবেদন যা উপেক্ষা করা যেকারো পক্ষেই অসম্ভব। গত ২৮ নভেম্বর গিয়েছিলাম কক্সবাজার নাজিরারটেক শুটকি পল্লীতে। সাথে ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক জসিম উদ্দিন সিদ্দিকী। তখনই দেখা হয় শাহরাজ বানুর সাথে।

চল্লিশোর্ধ নারী শাহরাজ বানুর এরকম আকুতি মাখানো কথায় পাষাণেরও মন গলবে। জীর্ণ শীর্ণ মলিন মুখ, চিকন আর হাড় বের হওয়া দুর্বল হাতে দু’গাছি সস্তা দামের চুঁড়ি, তপ্ত রোদে পোড়ানো গায়ের রং, বাদামি চামড়া পুড়ে কালচে হয়েছে বহু আগেই, এককালে হয়তো কালো ছিল কিন্তু এখন লালছে আর পড়তে পড়তে কমে আসা কগাছি চুল এলোমেলো করে বাধা, দেখলে বুঝা যায় ভাল খাবার পেটে পড়েনি বহুদিন- এমনই এক শ্রমিক শাহরাজ বানু। হয়তো চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানিও টলমল করছিল। কে জানে? কে বা খেয়াল করে। পাশেই কিছুটা খেলা আর মাঝে মাঝে দাদীকে সাহায্য করছে তার ৫ বছরের নাতনি। হয়তো সেও ট্রেনিং নিচ্ছে। আজ বাদে কাল- তাকেওতো লাগতে হবে এ কাজে।

শাহরাজ বানু

আলাপকালে শাহরাজ বানু বলেন, ‘সারাদিন খলায় কাজ করে বর্তমানে ৩০০-৩৫০ টাকা পাই। কোন কোন দিন এ হার একটু বাড়লেও তা নিতান্তই কম। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এ বাজারে তাই শাহরাজ বানুর ৮ সদস্যের সংসারে নিত্য টানাটানি। একটা আনলে একটা হয় না।

কক্সবাজার শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নাজিরারটেক। এখানে গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ শুটকি পল্লি। এই পল্লির যেদিকে চোখ যায়-হরেক রকমের মাছ দেখা যায়। ভাদ্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। সাগর থেকে আহরণ করা ২০ ধরনের মাছ রোদে শুকিয়ে শুটকি তৈরি করেন তারা। শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন লক্ষাধিক মানুষ।

নাজিরারটেক শুটকি পল্লি ঘুরে দেখা গেছে সাগর থেকে আহরণ করা ছুরি, লইট্যা, পোয়া, লাক্কা, মাইট্যা, রুপচাঁদা, চামিলা ও ফাইস্যাসহ হরেক রকম মাছ বাঁশের তৈরি মাচায় ঝুলানো কিংবা বিছিয়ে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। তপ্ত রোদে ঘাম ঝরানোর এই কাজে নারীর সংখ্যাই বেশি। আছে কম বয়সী শ্রমিকও। অনেকের এটাই পেশা, একমাত্র অবলম্বন।
জানা যায়,আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশে বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে শুটকি অত্যন্ত জনপ্রিয় মৎস্যজাত পণ্য। খাবার তালিকায় ভোজনরসিকদের কাছে শুটকিকে সুস্বাদু হিসেবে রাখা হয়। শুটকি ভর্তার সুনাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোক্তারা দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছেন শুটকির প্রতি। কেমিক্যালমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুস্বাদু এই শুটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ভোক্তাদের চাহিদা মতো প্যাকেট করে বাজারজাত করা হয় শুটকি। উৎপাদনের কোন পর্যায়েই লবন, বিষ ও ফরমালিন অথবা অন্যান্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। তাই মাছের প্রাকৃতিক স্বাদ ও মান বজায় থাকে। বিশেষভাবে প্রর্শিক্ষিত দক্ষ কর্মী দিয়ে কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

বঙ্গোপসাগর থেকে বছরে প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরিত হয়। যার মধ্যে শতকরা ২০-২২ ভাগ মাছ উপকুলের বিভিন্ন এলাকাতে শুটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। মূলত ৮-১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বাণিজ্যিকভাবে শুটকি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বছরে প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন শুটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এতে করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।

সামুদ্রিক শুটকির বড় অংশই উৎপাদিত হয় কক্সবাজারে। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ শুটকি তৈরির এলাকাগুলি হলো কক্সবাজারের নাজিরারটেক, সোনাদিয়া দ্বীপ, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, খুদিয়ারটোপ, আলী আকবর ডেইল, আমজাখালী, পশ্চিম ধুরং, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, সেন্টমার্টিন, সদর উপজেলার খুরুসকুল ।
সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস সময়ে শুঁটকি উৎপাদনের উৎকৃষ্ট সময় হলেও বর্তমানে মাছের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে এবং সরকারের বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারনে সারা বছরই কক্সবাজারের শুটকি মহালগুলোতে শুটকি উৎপাদন করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি বলতে আসলে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোন উপাদান মিশ্রিত নাই -এমন শুটকি বুঝায়। প্রকৃতপক্ষে শুটকিতে মানুষের খাদ্য নয় এমন কোন উপাদান একেবারেই থাকবে না এমনটা আশা করা ঠিক হবে না। কারণ, মাছে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা মানুষের খাদ্য নয় এমন উপাদান যেমন ময়লা, অনুজীব বা রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত থাকে। এসব উপাদান যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় বা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর কোন উপাদান যেমন কীটনাশক ইত্যাদি মিশ্রিত থাকে তাহলে তাকে স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি বলা যাবে না।

স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি না হলে রোগ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আসে প্রধানত তিনটি উৎস থেকে। যথা ক) ময়লা বা পঁচা জিনিসের মিশ্রণে (খ) অতিরিক্ত ক্ষতিকর অনুজীবের সংক্রমণে (গ) শুটকিতে অতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতিতে। শুটকি তৈরির জন্য কাঁচামাছ বা শুটকি তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ে বা তৈরি শুটকি স্বাস্থ্যসম্মত স্থানে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে নাড়াচাড়া না করলে মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্রসহ বিভিন্ন অখাদ্য দ্রব্যের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। অন্যদিকে অত্যধিক পঁচামাছ ব্যবহার করলে বা মানুষ ও পশুপাখির মাধ্যমে ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী (প্যাথোজেনিক) অনুজীবের সংক্রমণের ফলে রোগ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সবশেষে, মাছ অতিরিক্ত পচলে শুটকিতে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থেও উপস্থিতি বেড়ে যায় যা মানুষের জন্য রোগের কারন হতে পারে। তাছাড়া, শুটকি তৈরির সময়ে কীটনাশক ব্যবহার করলে তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের রোগ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়।

বর্তমানে দু’ভাবে কাঁচামাছকে শুটকিতে পরিণত করা হয়। (১) প্রচলিত পদ্ধতি (২) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি । প্রচলিত পদ্ধতিতে শুটকি মহালগুলোতে কাঁচামাছ রোদে শুকিয়ে শুটকি বানানো হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিএফআরআই (বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট) উদ্ভাবিত ‘‘ফিস ড্রায়ার’’ব্যবহার করে শুটকি উৎপাদন করা হয়। মশা মাছি ও কীট-পতঙ্গ নিরোধক ডায়িং হাউজে প্রাকৃতিক সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণ করে মাছ আদ্রতামুক্ত করা হয। শেষে সাত থেকে আট দিন ন্যাচারাল সানড্রাইয়ে শুকানোর পর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াজাত হয়ে গেলে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপামত্রায় ফ্রিজারে সংরক্ষণ করা হয়।

প্রযুক্তিগতভাবে বিএফআরআই ফিশ ড্রায়ারের মাধ্যমে যেকোন প্রজাতির মাছ শুটকি করা যায়। তবে অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে ছোট মাছ বিশেষ করে যে সকল মাছে বেশী পানি থাকে যেমন লইট্যা, কম লাভজনক। অন্যদিকে যে সকল মাছের শুটকি মুল্য অপেক্ষাকৃত বেশি যেমন রুপচাঁদা, ছুরি, লাক্ষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ ড্রায়ার বেশি উপযুক্ত।

স্থানীয় সাংবাদিক জসিম উদ্দিন সিদ্দিকীর সাথে নাজিরারটেক শুটকিপল্লীতে

প্রচলিত পদ্ধতিতে তৈরি শুটকির প্রধান সমস্যা হচ্ছে শুটকি উৎপাদনকারীরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে শুটকি উৎপাদন করে না। প্রথমত: মাছ সংগ্রহের সময় কম দামে ক্রয়ের জন্য পঁচা না তাজা মাছ- সে বাছ বিছার করে না। তারপর মাছ সঠিকভাবে পরিস্কার করা হয় না বলে মাছের গায়ে কাদা-মাটি লেগেই থাকে। অন্যদিকে মাছ বেশি পঁচা হলে বা আবহাওয়াজনিত কারনে বেশি পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে লবণ মেশান হয়। মাছ বাছাই ও লবণ দেওয়ার প্রক্রিয়া সরাসরি মাটিতে কখনোবা ছাটাইতে করা হয়। আশ-পাশের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের উপর খুব নজর দেওয়া হয় না। অপরিশোধিত কাদা-মাটি মিশ্রিত লবণই মেশান হয়। তাছাড়া, চারপাশে অসংখ্যা কুকুর আছে যেগুলি শুটকি তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ে শুটকি খায়। ফলে রোগ বালাইয়ের বিস্তার হতে পারে।

শুটকি তৈরির বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর দিকগুলি যেমন-ধুলা বাালি, কাদা,মাছি, কুকুর ইত্যাদির সংক্রমণ এবংসর্বোপরি কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়া উন্নতমানের স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি তৈরির জন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট(বিএফআরআই) এর সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শুটকি উৎপাদক শ্রেণির চাহিদা অনুযায়ী সময় সাশ্রয়ী ও দীর্ঘদিন ব্যবহার উপযোগি সার্বক্ষণিক অর্থাৎ রাত দিন ২৪ ঘন্টা ব্যবহার উপযোগি ড্রায়ার উদ্ভাবিত হয়েছে। সদ্য উদ্ভাবিত এ নতুন ড্রায়ারটির নাম রাখা হয়েছে ‘‘বিএফআরআই ফিশ ড্রায়ার’’ । এই ড্রায়ারটির মাধ্যমে শুটকি তৈরির স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত গুণগতমান সম্পন্ন শুটকি মাছ তৈরি করা হয়। এ ড্রায়ারটিতে সৌরশক্তি ও বিদ্যুৎ শক্তি উভয়ই ব্যবহার করা যায়। ড্রায়ারে সৌরশক্তি না বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে-তার উপর ভিত্তি করে আবার এর দুটি মডেল তৈরি করা হয়েছে। এই মডেল দুটিকে যথাক্রমে সৌর মডেল ও বৈদ্যুতিক মডেল বলা হয়। যেস্থানে পর্যাপ্ত বিদ্যুত শক্তির প্রাপ্যতা আছে সেখানে বৈদ্যুতিক মডেল আর যে স্থানে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ শক্তি নাই সেখানে সৌর মডেল ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। উভয় মডেলে স্বচ্ছ সেলুলয়েডের ঢাকনা থাকায় বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর দিকগুলির সংক্রমণ এবং সর্বোপরি কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়া উন্নতমানের স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি তৈরি করা হয়।
শুটকি বিষয়ে ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে কথা হয় কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান এর সাথে। শুটকি শিল্পের প্রসারে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকসহ ৯ উপজেলার ৩৫ মহালে শুটকি উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি বছর শুটকি উৎপাদন পূর্বের বছরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, শুটকি শিল্পের জন্য পূর্বে কোন আইনী কাঠামো ছিল না। বর্তমান সরকার ‘‘ মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ আইন-২০২০’’ প্রণয়ন করে এ শিল্পকে একটি সুন্দর ও স্বচ্ছ কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে চলছে আইনের অধীনে বিধিমালা প্রণয়নের কাজ। বিধিমালা প্রণয়ন শেষ হলে আইনটি আরো পূর্ণাঙ্গ রুপ পাবে। তিনি বলেন, মৎস্য অফিস থেকে মৎস্যজীবী, শুটকিমহাল মার্লিক ও শ্রমিকদের জন্য সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে চলতি বছর এ পর্যন্ত ৮ শত জনের সাথে মতবিনিময় সভা ও ১০০ জনকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বর্ষাকালে যাতে শুুটকি উৎপাদন করা যায় সেজন্য মহাল মালিকদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি সোলার ড্রায়ার, গ্যাস সিলিন্ডার ড্রায়ার ও ইলেক্ট্রনিক ড্রায়ার দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে শুটকিতে কীটনাশকের ব্যবহার রোধে অভিযান পরিচালনা ও স্যাম্পল টেস্ট করা হয়। চলতি বছর এ পর্যন্ত ২৭টি স্যাম্পল টেস্ট করে ৪টিতে কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে বছরে প্রায় ৪ শত কোটি টাকার শুটকি রপ্তানি হয়। এছাড়া ২০২২ সালে জেলা প্রশাসনের সভায় শুটকিকে এখানকার ‘‘পর্যটন পণ্য’’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

কথা বলছেন কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান

খোজ নিয়ে জানা গেছে সরকার কক্সবাজার সদর থানার খুরুসকুল ইউনিয়নে ৪৫ একর জায়গার উপর আধুনিক শুটকি পল্লী স্থাপন করছে। এ পল্লীর প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এর আওতায় এখানে শুটকি উৎপাদনের মহাল/খলা, শ্রমিক নিবাস, শুটকি বিক্রয় কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্টদের কার্যালয় থাকবে। শুটকিমহাল মালিক ও শ্রমিকদের বিনামূল্যে এ মহাল বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ পল্লীতে প্রায় ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে যাদের বেশিরভাগই হবে নারী শ্রমিক।

কথা বলছেন নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী মো. আজিজ উদ্দিন

গত ২৮ নভেম্বর,২০২৩ কথা হয় নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আজিজ উদ্দিন এর সাথে। নিজ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বসে তিনি বলেন, এ বছর আবহাওয়া ভাল থাকায় যথেষ্ট শুটকি উৎপাদন হচ্ছে। সবগুলো দোকান, মহাল শুটকিতে ভরপুর। তবে নির্বাচন, শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা, হরতাল অবরোধ প্রভৃতির কারনে কক্সবাজারে এখনো পর্যটকের সংখ্যা কম। তাই শুটকি বেচা বিক্রিও কম। আশা করা যায় ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে প্রচুর পর্যটক আসবে। তখন বেচা বিক্রিও ভালো হবে।

কথা বলছেন নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ কোম্পানী

নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ কোম্পানী বলেন, শুটকি মহালগুলোতে এখন পুরোদমে উৎপাদন চলছে। আমরা প্রতি শুক্রবার৫-৭টি ট্রাকে শুটকি চট্টগ্রামে পাঠাই। সেখানে শনিবারে লেনদেন হয়। এছাড়া দু’একজন করে পর্যটকও আসা শুরু হয়েছে। আশা করি এবারের বছরটি ভালো যাবে।

বর্তমানে প্রতি কেজি রুপচাঁদা ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, মাইট্যা ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা, কোরাল ৯০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, পোয়া ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চিংড়ি ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা, লইট্যা ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা, ছুরি ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকা এবং অন্যান্য মাছ ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। চট্টগ্রাম শহরের খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জে প্রতি শনিবার শুটকির হাট বসে। সে হাটে বেচা বিক্রি করার জন্য প্রতি শুক্রবার ৫-৭ ট্রাক শুটকি কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে আসে। একেকটি ট্রাকে ১০-১২ মেট্রিক টন শুটকি পাঠানো হয়। এখানকার শুটকি রপ্তানিকারক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীগণ এসব শুটকি কিনে রাখেন। আবার এখান থেকে দেশের সব জেলার পাইকার, খুচরা বিক্রেতারা ক্রয় করে নিয়ে যান।আর রপ্তানিকারকগণ বিদেশ পাঠিয়ে দেন। প্রতি সপ্তাহে কোটি টাকার শুটকি বেচা কেনা হয়।

শুটকি মহালগুলোতে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে। বিশেষ করে নাজিরারটেক শুটকি পল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে যত শ্রমিক কাজ করছে তার শতকরা ৮০ ভাগই নারী। অন্যান্য শুটকি মহালগুলোর অবস্থাও একই। সস্তায় নারী শ্রমিক পাওয়া যায় বলে মহাল মালিকরাও নারী শ্রমিকদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। তাছাড়া নারী শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো সহজ, প্রতিবাদ করে কম, সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, প্রয়োজনে একটু বেশি খাটিয়ে নেওয়া যায় প্রভৃতি কারনে মালিকরা নারী শ্রমিকে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। নারী শ্রমিকদেরও অন্য কর্ম না থাকায় শ্রমের তুলনায় কম মজুরি, সংসারের বোঝা, কোন না কোন কাজ করতে হবে ইত্যাদি কারনে মালিকদের শত বঞ্চনা নিরবে সহ্য করেও মহালে কাজ করে থাকেন। তবে এতে করে নারী শ্রমিকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে একথা বলা যায়।

একথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায় যে, স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি হলে সচেতন ক্রেতারা অধিক মূল্যে শুটকি ক্রয়ে আগ্রহী হবে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী আছেন যারা শুটকি অত্যন্ত পছন্দ করেন। এছাড়া অন্য দেশও কিনতে আগ্রহী হবে। নতুন বাজার সৃষ্টি হবে। ফলে রপ্তানির সুযোগ বর্তমানের চেয়ে আরো বাড়বে। বর্তমানে কক্সবাজারে বেড়াতে আসা অনেক পর্যটক যাওয়ার সময় নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজনের জন্য শুটকি নিয়ে যান। মানসম্মত এবং অর্গানিক শুটকি বাজারে পাওয়া গেলে নেওয়ার এ হার যে শতগুণ বেড়ে যাবে-একথা হলফ করে বলা যায়। তখন হয়তো শাহরাজ বানুদের অভাবের সংসারে সুদিন আসবে।

ফিচার প্রতিবেদক : জি. এম সাইফুল ইসলাম, তথ্য অফিসার, পিআইডি, চট্টগ্রাম।

চট্টগ্রাম পিআইডি ফিচার

আরও পড়ুন