শেখ হাসিনার সাংবিধানিক বাধা সত্ত্বেও জনগণের পাশে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী

ইকবাল কবির:: কর্তৃত্ববাদী, আমিত্ব আর আমার বাবার দেশ দাবি করা অহংকারী শেখ হাসিনা ছাত্রজনতার আন্দোলনের ঠেলায় ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ার একমাস পূর্ন হলো ৫ সেপ্টেম্বর। ২০০৮ সালের ৩০ডিসেম্বর সেনা শাসিত ফখরুউদ্দীন-মঈনুদ্দীন- সরকারের ভোট আয়োজনে ক্ষমতায় এসেছিলো শেখ হাসিনার সরকার। ২০০৯ সালের ১০জানুয়ারী থেকে সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র পরিচালনার সূচনা করেছিলেন শেখ হাসিনা। ২০১৪, ২০১৮ সর্বশেষ ২০২৪ উপর্যুপরি তিনটি নির্বাচনের নামে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ভোট নামক একটি গনতান্ত্রিক অনুষঙ্গ, জনগণের উৎসবমুখর অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লড়াইয়ের ঈদের আনন্দের মতো ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ততাকে ধ্বংস করে ভোটকে একটি আতংকের অধ্যায়ে পরিণত করেছিলেন। এ সবই করেছিলেন, ক্ষমতায় আঁকড়ে থেকে জনগণের রাষ্ট্রটাকে নিজের একক ক্ষমতার হাতিয়ার বানাতে। সাংবিধানিক পদগুলো হতে শুরু করে বিচারালয়, দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলো ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, কে সংসদ সদস্য হবেন না হবেন, কাকে জেলে ঢুকাতে হবে, কার কত সাজা হবে এর সবই যেনো তার ইচ্ছায় পরিচালিত করার একক ক্ষমতার অধিকারি হয়ে উঠেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে তিনি এভাবে একক ক্ষমতার অধিকারি হয়ে উঠলেন?

২০০৯ সালে সরকার গঠনের দেড় মাসের মধ্যেই ঢাকার পিলখানায় বিডিআরের সদরদপ্তরে ২৫ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে নির্মমভাবে বিডিআরের তৎকালীন ডিজি, ৫৭জন সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪জনকে হত্যাকরা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন আধাসামরিক বা সশস্ত্র বাহিনীতে বিদ্রোহের নামে একসঙ্গে এতো সামরিক কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের নজির নেই। আর সেনা অফিসার হত্যাকান্ডই ছিলো শেখ হাসিনার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার অন্যতম অবলম্বন। ক্ষমতায় এসেই দেড় মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে নির্মমভাবে এতগুলো চৌকস সেনা অফিসার হত্যাকান্ডের মাধ্যমে শেখ হাসিনা মূলতঃ সেনাবাহিনীর মাঝে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে তাকে ভয়ের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। একটি প্রবাদ আছে, বিয়ের প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হয়। যাতে করে সারা জীবন বউকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। শেখ হাসিনা যেন সেনা হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সেই কাজটি করে তার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ব্যবস্থাটি পাকাপোক্ত করেছিলেন।

১৯৭৫সালের ১৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো কতিপয় বিপদগামী সেনা কর্মকর্তা। তাই শেখ হাসিনার মনে সেনাবাহিনীর প্রতি একটি ক্ষোভ-ঘৃণা দীর্ঘদিন থেকেই বাসা বেঁধেছিলো।সুযোগ পেলেই তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ বা ক্যান্টনমেন্টে রাজনৈতিক দল গঠনে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সমালোচনা করতেন। প্রকারন্তরে সামরিক বাহিনীর প্রতি তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের কোন সরকারকে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে হলে বা জনরোষে পড়লে ক্ষমতা ছাড়া বা না ছাড়ার বিষয়ে সেনাবাহিনী একটি বিরাট ফ্যাক্টর। স্বাধীনতার পর দেশ শাসনের মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যেই আকাশসম জনপ্রিয় বাঙ্গালী জাতির জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব( শেখহাসিনার বাবা)কে নিহত হতে হয়েছিলো এই সেনাবাহিনীর হাতে। এরপর সেনা অভ্যুত্থান, পাল্টা সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানে সেনা অফিসার জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হন ১৯৭৫ সালের ৭নভেম্বর।পরবর্তিতে ১৯৮১সালের ৩০মে কতিপয় বিপথগামী সেনাবাহিনীর হাতেই চট্রগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন জিয়াউর রহমান। এরপর ১৯৮২সালের ২৪মার্চ বিনা রক্তপাতে দূর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে রাতের অন্ধকারে বিএনপির বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাশাসক এরশাদ। দীর্ঘ নয় বছর দেশ শাসনের পর জনআন্দোলনের মুখে সেনা শাসক এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয় ১৯৯০সালের ৬ ডিসেম্বর। যদিও তিনি সামরিক শাসক হওয়া সত্বেও শেখ হাসিনার মতো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। একজন রাজনৈতিক না হয়েও তিনি কারাবন্দী হয়েছিলেন, দেশ ছেড়ে পালাননি। রাজনৈতিক দল ও দেশের গনআন্দোলন হলেও মূলতঃদেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার ও তাকে জনগণের দাবি মেনে পদত্যাগ করার বার্তা পৌছে স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়েছিলো। সেই সময় সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম সরাসরি প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। এরশাদ চেয়েছিলেন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে দেশে সেনাশাসন জারি করতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর দেশ শাসনের বিষয়টি রাজনৈতিক হওয়ায় রাজি হননি। তাই সেনা সমর্থন না পাওয়ায় এরশাদকে পদত্যাগ করে জেলে যেতে হয়েছিলো। এরপর দেশে তিন জোট ও তৎকালীন সকল বিরোধী দলের রূপরেখা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। কিন্তু নির্বাচন যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলো দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচন আয়োজনে বিরোধী দলগুলো সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল নাসিমকে দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার নানান কৌশল অবলম্বন করেও শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী বেগম জিয়ার বিএনপি সরকারের পাশে না থাকায় বিএনপিকে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করিয়েই ক্ষমতা ত্যাগ করতে হয়েছিলো। ক্ষমতা ত্যাগে এখানেও সেনাবাহিনীই ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। এরপর ২০০৭ সালে আবারও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে লগি-বইঠার আন্দোলনে রাজপথ রক্তাক্ত হয়ে উঠে। বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মনোনীত প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরকে বিদায় করে দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। গঠিত হয় সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দীনের সরকার। সেনাবাহিনী দুই নেত্রীকে গৃহবন্দী করে সারাদেশে দূর্নীতিবাজ রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারী কর্মকর্তা ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে সারাদেশে আতংক ও জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন। এরপর দেশী-বিদেশী চাপের মুখে সেনাশাসকরা নির্বাচন দিয়ে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে সেনাশাসিত জরুরী অবস্থা জারি করা ফখরুউদ্দীন-মঈন ইউআহমেদ সরকারের বিদায় ঘটে। শেখ হাসিনা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সাল ও ২০০৭সাল দুই দফ ক্ষমতায় গিয়ে আর ক্ষমতা ছাড়তে চাননি। চেষ্টা করেছেন ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে। নানান কৌশল অবলম্বন করেও শেষ পর্যন্ত বিরোধী ও জনগণের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছেন মূলতঃ সেনাবাহিনীর সমর্থন না পাওয়ার কারনেই। ক্ষমতায় টিকে থাকার সকল চেষ্টা করেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। তাই শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসেই সেনাবাহিনীকে বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে হত্যার ছক কষে সেনাবাহিনীর মধ্যে হাসিনা আতংক ঢুকিয়ে দেন। যাতে করে সেনাবাহিনীর তার কথার বাহিরে না যায়। এরপর সংবিধান সংশোধন করে দেশে সরকার পরিবর্তনে রাজনৈতিক সংকট তৈরী হলেও যেন কেউ ক্ষমতা দখল বা দখলের চেষ্টা এমনকি উস্কানি দিলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি( মৃত্যুদন্ড)র বিধান সংবিধানে যুক্ত করেন, যাতে এরশাদের মতো কেউ সরকার হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহনের চেষ্টা না করেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প, উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত করে টাকার নেশায় মাতিয়ে দূর্নীতিগ্রস্থ করে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দেশপ্রেমে বিমূখ করে রাখার চেষ্টা করা। একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রমোশনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির আওয়াজ তুলে মূলতঃ আওয়ামীলীগ না করলে কারো প্রমোশন হবে না এমন একটি নীতিমালা বাস্তবায়ন করে সেনাবাহিনীকে তার আনুগত্যের রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠনে পরিনত করে তুলে। অযোগ্য অনেককেই সেনাপ্রধান করে তার কথার বাহিরে যাবেন না, এমন সন্ত্রাসী পরিবারের সদস্য জেনারেল আজিজকে সেনাপ্রধান করে সেনাবাহির সর্বোচ্চ পদটিকেও কলংকিত করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন।

জেনারেল আজিজ সেনা প্রধান হওয়ায় সেনা অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিলেন। এমনকি ক্যান্টনমেন্টে সেনা প্রধান আজিজ মুভ করলে অনেক জেনারেলরা সেই পথ পরিবর্তন করে অন্য পথে অফিসে যেতেন চলার পথে তাকে স্যালুট দিতে হবে এই ভেবে। মূলতঃ সেনাবাহিনীর প্রতি শেখ হাসিনার ক্ষোভ বা ঘৃণা থেকেই হয়তো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার এই বাহিনীটিকে তিনি নিজের পছন্দের বা আনুগত্য আছে এমনদের তিনি দূর্নীতি, লুটপাট ও বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন।তাদের দিয়ে বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসীদের গুম, খুন দমনপীড়নে ব্যবহার করেছেন, যার উদাহরণ বর্তমানে চাকরিচ্যুত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ অনেকে। দেড়দশক সেনাবাহিনীকে এভাবে ব্যবহার করা হলেও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম তিন বাহিনীর প্রধান ব্যাচমেট এবং তিন বন্ধু। মূলতঃতাদের বিচক্ষণতা বুদ্ধিমত্তায় দেশ এক আমিত্ব কর্তৃত্ববাদী শাসকের ও গৃহযুদ্ধের কবল থেকে মুক্তি পেলো।

জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনা ক্ষমতা শেষ সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেই ছাত্রজনতাকে গুলি করে হত্যা, প্রয়োজনে সামরিক শাসন জারি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী কর্তৃত্ববাদী আমিত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনার কথায় সায় দেননি। ওরা বাংলাদশের ছাত্রজনতার পাশে দাড়িয়ে দেশকে একটি গৃহযুদ্ধের কবল থেকে রক্ষা করে দেশকে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে নিতে ড.ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা দেশের ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক হানাহানির সৃষ্টি হলে সেনাবাহিনী জনগনের পাশে দাঁড়ানোর পথটিকে রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন, আজীবন ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে। কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর যৌথ নেতৃত্ব দেশকে এক মহা রাজনৈতিক সংকট ও গৃহযুদ্ধের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে শেখ হাসিনার কোন কূটকৌশলই আর কাজে আসেনি। সেনাবাহিনীসহ তিন বাহিনী ও ছাত্রজনতার বিজয় অর্জিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে তাদের অবদানের কারণে জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : ইকবাল কবির, ঢাকা ব্যুরো প্রধান, সিটিজি সংবাদ২৪ ডট কম।

আরও পড়ুন