দাম বেঁধে দেয়ার পরও বাজারে আগুন নিভছেনা

ডিম, আলু ও পিয়াজের বেঁধে দেয়া দাম একটিও কার্যকর হয়নি রাজধানীর বাজারগুলোতে। ৮ দিন পার হলেও তদারকি সংস্থা বাজারে নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে পারছে না। বরং দাম বেঁধে দেয়ার পর বাজারে উল্টো অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই দফায় ১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এরপরও বাড়তি দরেই ডিম বিক্রি হচ্ছে। পিয়াজ কিনতে ক্রেতার এখনো কেজিপ্রতি গুনতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা। আলুর বাজার আরও বেসামাল। অভিযানের খবরে কোথাও কোথাও পণ্যটি গায়েব হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়লেও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলান করার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে মধ্যবিত্তরা দিশাহারা। তারা আরও বলেছেন, চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও শুধুমাত্র বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে কিছু পণ্যে অযৌক্তিকভাবে দাম বেড়েছে।

যেখানে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ জীবনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে চাহিদা ছেঁটে, নিম্ন পুষ্টিমানের খাবার খেয়ে ব্যয় সংকুলান করছেন।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি ডজন ডিমের দাম কয়েক মাসের ব্যবধানে ১২৫-১৩০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৫০-১৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখন ১২.৫০ টাকায় প্রতিটি ডিম পাওয়া গেলেও ক’দিন আগেই এটি ১৫ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি আলুর দাম ৩০-৩৫ টাকা থেকে এক মাসের ব্যবধানেই ৪৫-৫০ টাকায় উঠেছে।

সরকার এক সপ্তাহ আগে আলু, ডিম ও পিয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দিয়েছে। প্রতিটি ডিম ১২ টাকা, আলু ৩৫-৩৬ টাকা কেজি এবং দেশি পিয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে সরকার। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। দাম বেঁধে দেয়ার প্রায় সপ্তাহখানেক পার হলেও একটি পণ্যও নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না। ডিম এখনো প্রতিটি ১২.৫০ টাকা, আলু ৪৫-৫০ টাকা এবং দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়।

এর মধ্যে পিয়াজের দাম ৫-১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে এবং আলু কিছু জায়গায় ৫ টাকা পর্যন্ত কমে মিলছে। আর ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার দুই দফায় ১০ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এসব আমদানির ডিম আগামী সপ্তাহ থেকে দেশে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন টাইগার ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী সাইফুর রহমান। এসব ডিম দেশে এলে ৯-১০ টাকায় বিক্রি হবে বলেও জানান তিনি।

পণ্যমূল্য বৃদ্ধির উত্তাপ লেগেছে বেসরকারি চাকরিজীবী খায়রুলের গায়ে। একটি সাবলেট বাসায় স্কুলপড়ুয়া এক ছেলেসহ তিন জনের সংসার তার। ডিমের দাম যখন কম ছিল, তখন সকালে প্রায় প্রতিদিন তিন জনে দুই-তিনটি ডিম সিদ্ধ করে খেতেন। এখন শুধু ছেলের জন্য একটি ডিমই সিদ্ধ হয়। ক্রমবর্ধমান খরচ তার মতো পরিবারগুলোর জন্য মানসম্মত জীবনযাপন কঠিন করে তুলেছে।

এদিকে ভোক্তা অধিদপ্তর প্রতিদিনই বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে সরকার নির্ধারিত দাম বাস্তবায়নের জন্য। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের কোল্ড স্টোরেজে অভিযান চালিয়ে ২৬-২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির নির্দেশ দেয়ার পর থেকে সেখানকার স্টোরেজ মালিকদের অধিকাংশ আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

কাওরান বাজারের আলুর পাইকারি বিক্রেতারা জানান, দাম বেঁধে দেয়ার পর থেকেই আলুর চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আলুর বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, আলুর দাম কারা বাড়াচ্ছে সে তথ্য আমরা সরকারকে দিয়েছি। কোল্ড স্টোরেজে যে পরিমাণ আলু আছে তা দিয়ে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটানো যাবে।
বুধবার রংপুরে তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সাংবাদিকদের ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, আমরা কোল্ড স্টোরেজে আলুর দর ২৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এরপরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও কোল্ড স্টোরেজের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট করে আলুর বাজার অস্থির করে তুলেছেন। আমরা এসব সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছি। আরও তিন-চার দিন দেখবো। এর মধ্যে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ডিমের মতো আলুও আমদানির জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হবে।

সীমিত আয়ের মানুষ সাধারণত ডিম, পোল্ট্রি মুরগি, পাঙাশ, তেলাপিয়া ও আলুর ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু এই সবক’টি পণ্যই এখন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। ১৪০-১৫০ টাকার ব্রয়লার মুরগি এখন ১৮৫-১৯০ টাকায়, তেলাপিয়া মাছের দাম আকারভেদে ১২০-১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০-২৫০ টাকা, পাঙাশ মাছ ১১০-১২০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৭০-২২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ২৫০ টাকা কেজি দরের রুই মাছও এখন ৩৫০-৪৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য বলছে, দরিদ্র মানুষের মোটা চালও এখন ৫০ টাকার নিচে নেই।

এদিকে গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২.৫৪%, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ডিম ও মুরগির দামের কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সীমিত আয়ের মানুষের খাবারগুলোর দাম যখন বাড়বে তখন আর তাদের কোনো বিকল্প থাকে না, কষ্টের মধ্যেই চলতে হয়। বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং বাজারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আইনের কঠোর প্রয়োগের পরামর্শ দেন তিনি।

আরও পড়ুন