বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে কেন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে

বিশ্ববাজারে সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দামে এর কোন প্রভাবই নেই। উল্টে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অগাস্ট মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১২.৫৪ শতাংশ, যা দেশের গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অগাস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো ২০২২ সালে দেশে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো এ বছরের অগাস্টে সেই একই পণ্য কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১১২ টাকা ৫৪ পয়সা। অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এর তথ্য অনুযায়ী, গত অগাস্ট মাসে সারা বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে সর্বনিম্ন হয়েছে। এই সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে।
এর আগে দেশে পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টিকে ব্যবহার করা হলেও এখন সেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলেও তার প্রতিফলন কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির এই বিষয়টি শুধু অগাস্ট মাসের বিষয় নয়, বরং গত বছরের মার্চ থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার এ প্রবণতা শুরু হয়েছে তা আর কমানো যায়নি, আর বর্তমানে আমারা তা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা। এ পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন টাকা ছাপানো, সুদের হার বৃদ্ধি না করা, ডলার সংকট, সরকারের ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপ এবং সেই সাথে বাজার ব্যবস্থাপনার উপর কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতির মূল কারন হিসেবে দেখছেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের প্রথম আঠারো দিনে সরকারকে সহায়তা করতে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে দশ হাজার আটশ কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এখন যে পণ্যের বাজারে দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলছে তার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ। এছাড়াও বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি থাকার কারণে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রা বা নোট ছাপিয়ে সেই টাকা সরকারকে সরবরাহ করে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, গত অর্থ বছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছে যার জন্য টাকা ছাপাতে হয়েছে এবং এ বছরও সরকার সেই প্রবণতা থেকে সরে আসেনি।
“ফলে মুদ্রানীতিতে যখন দরকার ছিলো মুদ্রা সরবরাহ সংকোচন করা, তখন এই পদক্ষেপটা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়াটা), নতুন করে আবার উসকে দিয়েছে মূল্যস্ফীতির সেই প্রবণতাকে,” বলেন তিনি।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ হার বাড়েনি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সুদের হার বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সুদের হার নির্ধারিত ছিল। যার আওতায় আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ এবং ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদের হার ধার্য করা ছিল। যদিও গত মাস দুয়েক সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিষয়ে কিছুটা নমনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
তারা সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্মার্ট সুদহার নামে নতুন নিয়ম চালু করেছে। স্মার্ট হলো সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। অর্থাৎ প্রতি মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার বিবেচনায় নতুন সুদহার ঠিক করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই হারের সাথে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারেনি।
তাদের মতে, এই ধরণের সুদের হার সুনির্দিষ্ট করে রেখে বা সাম্প্রতিক সময়ে যে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে তা দিয়ে এ ধরণের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “নীতিগত পর্যায়ে মনিটারি পলিসিতে একটা বড় ধরনের ভুল ছিল। আর সেই ভুলের যে কারেক্টিং মেজার্স দরকার – তা কিন্তু ঠিকমতো হয়নি।”

ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে বলে মনে কররন অর্থনীিতবিদরা। তাদের মতে, ২০২২ সাল থেকে শুরু করে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দফায় দফায় টাকার অবমূল্যায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৩.৩ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এক ডলারের বিপরীতে ৮৫.৮০ টাকা পাওয়া যেতো। কিন্তু ওই বছরের ডিসেম্বরে এই বিনিময় হার এসে দাঁড়ায় ১০৫.৪০ টাকায়। আর ২০২৩ সালের ১৪ই অগাস্ট এসে ডলারের দাম ১০৯.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এতে করে আমদানি কমলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না।

বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের অভিঘাত হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, বৈশ্বিক বাজারে যে মূল্যটা কমেছে, টাকার অনুপাতে সেই পরিমাণটা কমছে না। এটা টাকার অবমূল্যায়নের একটা ফলাফল বলে মনে করেন তিনি।

ড. সেলিম রায়হান বলেন, একদিকে যেহেতু টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, তাই আমদানি মূল্য বেড়ে গেছে। তাই সরকারের উচিত ছিল, আমদানির উপর যেসব কর ও শুল্ক রয়েছে সেগুলো কমিয়ে নির্ধারণ করা যাতে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকে। তবে ঠিক সময়ে এমন পদক্ষেপও নেয়নি সরকার। “এই যে রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রেও ট্যাক্স অ্যাডজাস্টমেন্ট করেও একটা সহনীয় পর্যায়ে দেশের বাজারে পণ্যকে নিয়ে আসা, সেই উদ্যোগটা কিন্তু আমরা দেখিনি।”

বাংলাদেশে সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২৩.০৬ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছর ধরে রিজার্ভের এই আকার কমেই চলেছে এবং এখনো পর্যন্ত তা ঠেকানো যাচ্ছে না।

এর মধ্যে গত অগাস্টে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১.৪৮ শতাংশ কমেছে বলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়। এর আগে জুলাই মাসেও রেমিট্যান্স ৫.৮৮ শতাংশ কম এসেছিল।

মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ডলার সংকটের কারণে বাজারকে সচল রাখার জন্য যেভাবে এলসি খোলার মাধ্যমে আমদানি করা হয়, সেটিও এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রিজার্ভে ঘাটতি এবং ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে বেগ পেতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। তাদেরকে ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে আরো বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
“এলসি যখন ব্যবসায়ীরা খুলতে যাচ্ছেন, তখন তাদের ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে না এবং তার ফলে সময়মত আমদানি করা যাচ্ছে না। তার ফলে স্থানীয় বাজারে চাহিদা ও সরবরাহ সাংঘর্ষিক অবস্থায় আছে এবং সে কারণে মূল্য বাড়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।” “সুতরাং সেই মূল্যটা বাজারে প্রতিফলিত হচ্ছে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। তার মতে, উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর- এই দুই পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্ত্বভোগী রয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে বাজারটা একচেটিয়াভাবে চলে গেছে। “তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেটার কারণে যে মূল্যটা সেটা বাজারের প্রতিযোগিতার সক্ষমতার নিরিখে হচ্ছে না।” তিনি বলেন, এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই বাজারের মূল্য নির্ধারণ করছে এবং অনেক সময় সরবরাহকে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে সামনে এনেছেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, অনেক ব্যবসায়ীরা একটা সাময়িক সরবরাহ সংকট তৈরি করে কোন কোন পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ফেলে। যেটার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

চিনি বা ভোজ্য তেলের মতো খাতে সরবরাহকারীর সংখ্যাও হাতেগোনা, মাত্র তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বাজারকে প্রভাবিত করার প্রবণতা আছে বলে মনে করেন তিনি।

“বাজারে অ্যান্টি-কমপিটিটিভ প্র্যাক্টিসের (প্রতিযোগিতাহীন অবস্থা) নিদর্শন পাওয়া যায়, অথচ এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোন শক্তিশালী পদক্ষেপ আমরা দেখি না,” বলেন মি. রায়হান।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠান আছে যেমন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বা প্রতিযোগিতা কমিশন – এসব প্রতিষ্ঠানের খবরদারিতে দুর্বলতা রয়েছে। আর এ কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, এসব প্রতিষ্ঠানের উচিত বাজারব্যবস্থাকে একটা নজরদারির মধ্যে নিয়ে এসে, মূল্যস্ফীতি অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা।

তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক সিদ্ধান্তের অভাবকেও দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারে তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বড় ধরণের দুর্বলতা রয়েছে। যেমন, বাজারে চাহিদা কত, সরবরাহ কত, উৎপাদন কত, আমদানি কতটুকু করতে হবে এবং সেটা কোন সময়ে করতে হবে, সেই আমদানিটা উন্মুক্তভাবে হচ্ছে কি না – এসব তথ্যের ভিত্তিতে বেশিরভাগ সময়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। ফলে যথেচ্ছভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে খাদ্য মূল্য ঠেকানো যায় না।

আরও পড়ুন