ওসি আলমগীর’র সম্পদের উৎস খুঁজছে দুদক

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), নগরীর চকবাজার, পতেঙ্গা, আকবরশাহ এবং কর্ণফুলীতে ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনে করেছেন মুহাম্মদ আলমগীর প্রকাশ আলমগীর মাহমুদ। ১৯৯৯ সালে এসআই হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের ছায়ায় পেয়েছেন পদোন্নতি-বদলি। দীর্ঘ এই কর্মজীবনে মুহাম্মদ আলমগীর কর্মের মাধ্যমে অবদানের বদৌলতে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। শুধু নিজের নামে নয়, কাড়ি কাড়ি সম্পত্তি রয়েছে স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের নামেও। এসব অর্থ এবং সম্পদ অর্জনের পেছনে যেসব খাত দেখিয়েছেন সেখানেও দেখা গেছে গরমিল। এ ছাড়া মুহাম্মদ আলমগীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে জব্দকৃত মাদক বিক্রি, ঘুষ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার।

জানা গেছে, আলমগীরের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানাধীন ধামাইরহাটের দক্ষিণ রাজানগরে। তার বাবার নাম বাদশা মিয়া। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানাধীন মহিলা কলেজের বিপরীতে নাসিরাবাদ প্রপার্টিজ লিমিটেডে’র ভেতরে ৫ তলায় একটি ফ্ল্যাট এ থাকেন। চাকরীতে যোগ দিয়ে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর ৩বার (মিশন) এ যান আলমগীর। তিনি সিএমপিতে যোগদান করেন ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর। তিনি সিএমপির গোয়েন্দা শাখা, আকবর শাহ, কর্ণফুলী এবং পতেঙ্গা ও চকবাজার থানায় কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম রেঞ্জে কক্সবাজার জেলার অপরাধ শাখায় দায়িত্বে আছেন। ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন বলে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে। তিনি চাঁদপুর, রাঙ্গামাটি, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও কক্সবাজার জেলায়ও চাকরি করেন। এ ছাড়া পেশাগত জীবনে পুরস্কার পেয়েছেন ৩৭টি। তার এভাবে তরতর করে বেড়ে ওঠার পেছনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন বলে বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে।

আলমগীর-তাসলিমা দম্পতির টাকার পাহাড় : সাবেক ওসি মুহাম্মদ আলমগীর প্রকাশ আলমগীর মাহমুদ ২০১৮-২০১৯ করবর্ষের সম্পদ বিবরণীতে মৎস্য প্রকল্প খাতে আয় দেখিয়েছেন ৭৬ লাখ ৪৮ হাজার ৩০০ টাকা। একই খাতে তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার আয় দেখিয়েছেন ৯০ লাখ ৪৫ হাজার ৮২০ টাকা। বাস্তবে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই এরকম কোন মৎস্য প্রকল্পের অস্থীত্ব নেই। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্তে এ অনিয়ম ধরা পড়েছে।

চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগ সূত্রে প্রাপ্ত ওসি আলমগীরের সম্পদ বিবরণে দেখা গেছে, ন্যাশনাল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে ওসি আলমগীরের আছে প্রায় দেড় কোটি টাকার ৯টি এফডিআর একাউন্ট। তার আছে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। করেছেন ২০ লাখ টাকার বীমা। স্ত্রী তাসলিমার আছে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। ওসি আলমগীর ২০১৮-২০১৯ করবর্ষে তার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখান ২ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৬ টাকা। এর আগের করবর্ষে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২ টাকা। এ হিসেবে এক বছরেই তার সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি।

জানা গেছে, ওসি মুহাম্মদ আলমগীরের ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। সোনালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখা থেকে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি এ সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন। ২০১৮-২০১৯ করবর্ষের নথি অনুযায়ী পলি হসপিটাল লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে ওসি আলমগীর বিনিয়োগ দেখান ৩২ লাখ ২ হাজার ১৬০ টাকা। ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কিনেছেন প্রাইভেটকার। একই করবর্ষে স্বর্ণ, ফার্ণিচার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ সব মিলিয়ে তার সম্পদ এবং বিনিয়োগ মোট পরিমাণ দেখিয়েছেন ৯১ লাখ ৯ হাজার ১৪৭ টাকা।

২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর বীমা করেছেন ২০ লাখ টাকার (জীবন বীমা কর্পোরেশন)। ন্যাশনাল ব্যাংক চট্টগ্রামের জুবীলি রোড শাখায় আছে প্রায় ৩২ লাখ টাকার এফডিআর। একই ব্যাংকে পৃথক তিনটি হিসাব নম্বরে আছে প্রায় ৪৯ লাখ টাকার এফডিআর। এছাড়া এফডিআর আছে ৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকার, ১৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭৭৬ টাকার। এ ব্যাংকে লেনদেনের তথ্যে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল ১৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭৭৬ টাকা ৪৮ পয়সা।

এদিকে ২০১৯-২০২০ করবর্ষে সম্পদ বিবরণীতে রাংগুনিয়ার পশ্চিম নিচিন্তাপুর মৌজায় কৃষি সম্পদের পরিমাণ দেখান ৫৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা মূল্যের প্রায় ১৪৩ ডেসিমাল জমি। ২০১৮ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবে ক্যাশ এন্ড ব্যালেন্স দেখানো হয়েছে ৯১ লাখ ৯ হাজার ১৪৭ টাকা। বেতন, ব্যাংক ইন্টারেস্ট, মৎস্য খামার এবং সঞ্চয়পত্র খাতে লভ্যাংশ বাবদ আয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৭ টাকা। ২০১৮-২০১৯ করবর্ষে সম্পদ বিবরণীতে ওসি আলমগীরের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার ব্যবসা খাতে বার্ষিক আয় দেখান ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭০০ টাকা। সম্পদ বিবরণীর ৩ নং শিডিউল (ইনভেস্টমেন্ট ট্যাক্স ক্রেডিট) ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার কথা উল্লেখ করেন তার স্ত্রী তাসলিমা।

তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের ২০১৯-২০২০ করবর্ষের সম্পদ বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নগরের পাঁচলাইশ মৌজায় ২৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকা মূল্যের ৪ দশমিক ৩৩ ডেসিমাল এবং একই মৌজায় ২৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা দামের ৪ ডেসিমাল জায়গা। ২০১৮ সালের ১ জুলাই ব্যাংক ব্যালেন্স দেখানো হয়েছে ২৪ লাখ ২১ হাজার ৭০৮ টাকা। মৎস্য খামার থেকে আয় দেখিয়েছেন ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭০ টাকা। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত তার ব্যাংক ব্যালেন্স দেখানো হয় ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ৫১৯ টাকা। একই কর বর্ষে আয়করসহ মাট ব্যয় দেখান ১২ লাখ ৫০ হাজার ৬৫০ টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তাসলিমা মোট সম্পদের পরিমাণ দেখান ১ কোটি ৫২ লাখ ৩৩ হাজার ১৬৯ টাকা। তাসলিমা তার সম্পদ এবং দায় বিবৃতিতে ব্যবসায় মূলধন দেখান ৩৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬১ টাকা। এর মধ্যে রিটার্ন আয় দেখান ১০ লাখ ৩০ হাজার ৭৯১ টাকা, মৎস্য চাষ খাতে আয় দেখিয়েছেন ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭০ টাকা।

কর কর্মকর্তারা বলছেন, দুই করবর্ষে স্বামী-স্ত্রী দুজনের সম্পদ বিবরণীতে মৎস্য প্রকল্প খাতে প্রায় চার কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন। যার পুরোটাই অবৈধ উপায়ে অর্জিত। বিপুল পরিমাণ এ টাকা সাধারণ আয় হিসেবে গণ্য করে কালো টাকা সাদা করার অপকৌশলকে নস্যাৎ করে দেন। দাবি এনবিআর কর্মকর্তাদের। এখানেই শেষ নয়, পুলিশ কর্মকর্তা আলমগীর এবং তার স্ত্রীর সম্পদ বিরবণীতে আছে অঢেল সম্পদের পিলে চমকানো তথ্য।

চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ, বায়েজিদ বোস্তামি এলাকা ছাড়াও গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার ধামাইরহাট এলাকায় তাদের আছে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট, কৃষি-অকৃষি সম্পত্তি, আছে বেসরকারি হাসপাতালের শেয়ারও। বায়েজিদ বোস্তামি থানাধীন রূপনগর আবাসিক এলাকায় ওসি আলমগীর জনৈক বাবুলের কাছ থেকে কিনেছেন ৫ কাঠা প্লট। দক্ষিণ খুলশি ও নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে আছে দুই ইউনিট বিশিষ্ট দুটি ৬ তলা ভবন। নাসিরাবাদ প্রোপার্টিজের গলির ভেতরে ৫ নম্বর রোডে অবস্থিত একটি ভবনের চারতলায় আছে ৪ হাজার বর্গফুটের ২টি ফ্ল্যাট।

আরও যত অভিযোগ :: এদিকে ওসি আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ। কর্মজীবনে এতসব অর্থ আয়ের পেছনে রয়েছে হাজারো অপকর্ম। যার কিছু বিষয়ে মানুষ মুখ খুলেছে আবার অনেক কিছু রয়ে গেছে অন্তরালে।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে উত্তর রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ রাজানগর গ্রামের বাসিন্দা হামিদ উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি পুলিশ সদর দপ্তরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ওসি আলমগীর দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৫কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি উদ্ধার হওয়া মাদক সরকারিভাবে কম দেখিয়ে বাকিগুলো বিক্রি করে দেন। নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেন। এছাড়া তার স্ত্রী’র নামে আছে কোটি কোটি টাকা, করেছেন বাড়ি-গাড়ি। অভিযোগ পেয়ে ওসি আলমগীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব খাদিজা তাহেরা ববি সিএমপি কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি (স্মারক-৪২০) দেন।

হামিদ উল্লাহর অভিযোগটি পুলিশের পাশপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-২ তদন্ত করছে। ওসি আলমগীরের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ তদন্তকারী দুদকের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বলেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে বদলি হওয়ার আগে ওসি আলমগীরের বিষয়টি তদন্ত করেছি। তবে শেষ করতে পারিনি। তদন্তে ওসি আলমগীর ও তার স্ত্রীর অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে। আমি তাদের সম্পদের ডিক্লেরেশন দিয়েছি। এরপরই তো তারা এনবিআর এ সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে সিএমপির অন্যতম এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, তিন বার মিশনে গিয়ে ওসি আলমগীর আয় করেছেন ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মিশনে যাওয়া এবং পুরো চাকুরি জীবনের বেতন বাবদ এখন পর্যন্ত সঞ্চয় দাঁড়ায় ২-৩ কোটি টাকা। তবে বাস্তবে ওসি আলমগীরের অর্থ এবং সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ বেশি।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা :: এসব বিষয়ে জানতে কক্সবাজার জেলার অপরাধ শাখায় দায়িত্বে থাকা সাবেক ওসি মুহাম্মদ আলমগীরের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে যোগাযোগ করবেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সাড়া মিলেনি।

এদিকে দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচারক মোসাব্বির আহামমেদ বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত এবং নিরাপত্তার স্বার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। আর কোন অভিযোগ থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

সাবেক ওসি মুহাম্মদ আলমগীরের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো নজরে আনলে এসব বিষয়ে অবগত নন বলে জানান চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ। এর সাথে যুক্ত করে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সেই সাথে অভিযোগেরে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতেও বলেন তিনি।

আরও পড়ুন