এসি আকরামের জবানবন্দিঃ মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুকে খুন করতেই ফ্লাট ভাড়া করা হয়

প্রথম প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২১ইং

রাজধানীর মোহাম্মদপুর রেডক্রিসেন্ট’র ব্লাড সেন্টারের পাশেই একটি ফ্লাট ভাড়া করা হয় দেশের ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী নারায়নগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরু মিয়া চৌধুরী বাচ্চুকে হত্যার জন্য। ফ্লাটটি ভাড়া নেয়ার পর মাত্র একরাতই ব্যবহার করা হয়েছিলো। কিলিং মিশন শেষে খুনীরা ফ্লাট ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে দেশের চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর অন্যতম ছিলো মুক্তিযোদ্ধা নুরু মিয়া চৌধুরী বাচ্চু হত্যা। তিনি নাভিলা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন। তার পাটনার ছিলো শাহ আলম নামে আরেক ব্যবসায়ী।৮৬ সালের নভেম্বর মাসে আরিচা ঘাটের টয়লেটের পাশে একটি প্রাইভেটকারের ব্যাকডালায় বস্তাবন্দি অবস্থায় বাচ্চুর লাশ পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্বের কারণে বাচ্চুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার প্রায় একবছর পর বাচ্চুর খুনীকে আটক ও খুনের রহস্য উদঘাটনের বর্নণা করছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসাইন।

প্রায় একবছর ধরেই ক্লু’লেস এই মামলাটি ঘুরপাক খাচ্ছিলো থানা পুলিশ, সিআইডি ও ডিবি পুলিশের অফিসে। কেউই এর কোন কুল কিনারা করতে পারছিলেন না। আরিচা ঘাটে বস্তাবন্দী বাচ্চুর হাতের আঙ্গুলে থাকা মূল্যবান হিরের আংটিটি দুর্বৃত্তরা নিয়ে গিয়েছিলো তার আঙ্গুল কেটে। ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী বাচ্চুর সুন্দরী নারীর প্রতি দুর্বলতা ছিলো। তার ব্যবসায়ীক বন্ধু এই বিষয়টি জানতেন। তাই বাচ্চুকে হত্যার জন্য সুন্দরী নারীর ফাঁদ পাতা হয়। মোহাম্মদপুর আওরঙ্গজেব রোডে একটি ফ্লাট ভাড়া করেন তারই ব্যবসায়ীক বন্ধু।ওই ফ্লাটে রাখা হয় এক সুন্দরীকে। ঘটনার দিন বিকেলেই বাচ্চু তার গাড়ির চালককে ছুটি দিয়ে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আওরঙ্গজেব রোডের ওই ফ্লাটে যান। আগেই সেখানে মদ, নারীসহ বাচ্চুর পছন্দের সব কিছুই প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো। সেই সঙ্গে তাকে খুনের জন্য ভাড়াটিয়া খুনীদেরও আগেই সেই ফ্লাটে এনে রাখা হয়েছিলো। সুন্দরী রমনীর হাতে মদ্য পানে করিয়ে বাচ্চুকে মাতাল করে দেয়ার এক পর্যায়ে তাকে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করে ভাড়াটিয়া খুনীরা। এরপর তার মরদেহের বিভিন্ন স্থানে ছুরি দিয়ে আঘাত ও মাথায় গজাল মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করে।এরপর বাচ্চুর লাশ বস্তায় ভরে তারই গাড়ীর ব্যাকডালার পেছনে ভরে আরিচা ফেরিঘাটের টয়লেটের নিকট ফেলে দেয় খুনীরা। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর লাশ সন্ধ্যায় যখন শিবালয় থানা পুলিশ উদ্ধার করে তখনও তার কোন পরিচয় মিলেনি।গাড়ির ব্যাকডালায় থাকা গরমে রক্ত মাখা লাশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিলো।

বহুল আলোচিত ক্লু’লেস এই হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করেছিলেন এসি আকরাম হোসাইন।শরিয়তপুরে ডাকাত ধরতে গিয়ে পতিতা পল্লীর সুন্দরী শিউলী ছিলো মোহাম্মদপুর আওরঙ্গজেব রোডের ফ্লাটে বাচ্চুর মনোরঞ্জনের পাতা ফাঁদের সুন্দরী। সঙ্গে খুনে অংশ নেয়া তারই প্রমিক ঢাকার সন্ত্রাসী বুড্ডা। এসি আকরাম বললেন, ডাকাত ধরতে আমরা যখন শরিয়তপুরের পতিতা পল্লীতে পতিতাদের কাস্টমার সেজে ওৎপেতে ছিলাম তখই স্হানীয় সোর্স আমাদের জানায় পতিতা পল্লীর সুন্দরী শিউলীর আঙ্গুলে একটি হিরার আংটি আছে। পতিতার হাতে হিরার আংটি থাকার কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে এসি আকরামের মনে পড়ে আরিচা ঘাট থেকে উদ্ধার হওয়া বাচ্চুর হাতে হিরের আংটি খোয়া যাওয়ার কথা। তাই ভাবলেন ডাল মে কুচ কালা হায়। কৌশলে পতিতা সুন্দরী শিউলীর কাছে জানতে চাইলেন এতো দামি আংটি তার কোন আশিক দিলো। শিউলি বললেন, তার প্রেমিক বন্ধু ঢাকার বুড্ডা। এসি আকরাম বুড্ডার সম্পর্কে ভাল করেই জানেন সে একটা পেশাদার ভাড়াটে খুনী। টাকার বিনিময়ে এমন কোন কাজ নাই যা বুড্ডা করেন না। তবে তাকে তিনি নাগালে পাচ্ছিলেন না। এর আগে বুড্ডাকে কখনো এসি আকরাম গ্রেফতার না করায় তাকে চিনেন না। তাই তিনি ভাবলেন, এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। ডাকাত ধরার অভিযানে পরিবর্তন এনে এবার বুড্ডার জন্য অপেক্ষার পালা। এসি আকরামের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো হয়তোবা ক্লু,লেস বাচ্চু হত্যার জট আজই খুলে যেতে পারে। এই হিরের আংটি পৌঁছে দিতে পারে বাচ্চুর খুনীদের কাছে।

পতিতা শিউলি জানালো আজ সন্ধ্যায়ই বুড্ডা আসবে। সে নিশ্চিত। এসি আকরামের কাছে তখন একেকটি মিনিট একবছরের সমান মনে হচ্ছিলো। যেন সময়ই যেতে চাচ্ছে না। পতিতা পল্লী থেকে বের হয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গেই শহরে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেউ যেন টের না পান। তবে তার টিমের সবার অভিনয় ছিলো এক্কেবারে ন্যাচারাল। অপেক্ষার সময় শেষ হয়না। কখন সন্ধ্যা হবে বুড্ডা আসবে। এসি আকরাম শিউলিকে বলে এসেছিলেন, বুড্ডাকে একটি বড় কাজ করতে দিবেন। সে আসলেই যেন তাকে খবর দেয়া হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় সতর্ক দৃষ্টি ছিলো সবার পতিতা পল্লীর শিউলির ঘরের দিকে, কোনক্রমেই যেন শিকার ফসকে না যায়।কারণ শিউলির আংটি আর বুড্ডাই হয়তো একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার জট খুলে দিবে। টিমের সবার মাঝেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। পতিতালয়ে কত কাস্টমার আসছে যাচ্ছে। কিন্তু কাংখিত বুড্ডার অপেক্ষায় সবাই। এরই মধ্যে খবর আসলো বুড্ডা ঢুকেছে শিউলির রুমে। বিলম্ব না করে শিকারিও ঢুকে পরে শিউলির রুমে। তাদের আর কোন সময় না দিয়েই কিছু বুঝে উঠার আগেই এসি আকরাম বুড্ডার হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ঢাকার ডিবি পরিচয় দিয়ে দুজনকেই আটক করেন। এর আগেই বুড্ডার চারপাশ থেকেই ঘিরে রেখেছিলো এসি আকরামের চৌকস পুলিশের সদস্যরা। ইন্সপেক্টর সুলতান, শাহজাহান, রবসহ একদল সিভিল পোশাকের ফোর্স।

দ্রুত তাদের পতিতা পল্লী থেকে বের করে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেন। রাতভর ডিবি অফিসে ব্যাপক জিজ্ঞাবাদের বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর বাচ্চু হত্যার রহস্য। আটক বুড্ডা জানায়, আওরঙ্গজেব রোডের সেই ফ্ল্যাটটি বাচ্চুকে খুনের জন্য মাত্র একদিনই ব্যবহার করেছিলো। খুনের পর তারা আর ওই বাড়িতে যায়নি। বাচ্চুর ব্যবসায়ীক পাটনারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারনেই তাকে খুনের এই মিশন দেয়া হয়েছিলো। দেশের চাঞ্চল্যকর নুরু মিয়া চৌধুরী বাচ্চু হত্যার রহস্য উদঘাটনের বর্নণা এভাবেই করছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের চৌকস অফিসার আকরাম হোসাইন।

আরও পড়ুন