সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মানতে হবে সরকারি নির্দেশনা

বিগত ঈদুল আজহায় যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত ৭৭৪ জন আহত হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ৩৫৪টি দুর্ঘটনায় ৪৪০ জন নিহত ও ৭৯১ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গত ১৯ জুলাই রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২২ প্রকাশকালে এসব তথ্য তুলে ধরেন। সংগঠনটির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল প্রতি বছরের ন্যায় এবারো প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

বিগত ২০২১ সালের ঈদুল আজহায় লকডাউনের কারনে যাতায়াত সীমিত থাকায় এবারের ঈদে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। এবারের ঈদে রাজধানী ঢাকা ছেড়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। এক জেলা থেকে অপর জেলায় আরো প্রায় ৪ কোটি মানুষের যাতায়াত হয়েছে।

ঈদযাত্রা শুরুর দিন গত ০৩ জুলাই থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১৭ জুলাই পর্যন্ত বিগত ১৫ দিনে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত ৭৭৪ জন আহত হয়েছে। উল্লেখিত সময়ে রেলপথে ২৫ টি ঘটনায় ২৫ জন নিহত ও ০২ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ১০ টি দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও ১৫ জন আহত এবং ০৩ জন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা মিলেছে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে যৌথভাবে ৩৫৪টি দুর্ঘটনায় ৪৪০ জন নিহত ও ৭৯১ জন আহত হয়েছে। বিগত ৭ বছরের ঈদুল আজহায় যাতায়াতের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহাণি দুটোই সর্বোচ্চ।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটর সাইকেল। এবারের ঈদে ১১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত, ৬৮ জন আহত হয়েছে- যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫.৪২ শতাংশ, নিহতের ৩২.৯১ শতাংশ।

এ সময় সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ১৫৭ জন চালক, ৮ জন পরিবহন শ্রমিক, ১০৬ জন পথচারী, ৬২ জন নারী, ৫১ জন শিশু, ৩৬ জন শিক্ষার্থী, ৬ জন সাংবাদিক, চিকিৎসক ৪ জন, ৫ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৬ জন শিক্ষক, ৬ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং ১ জন প্রকৌশলীর পরিচয় মিলেছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ৩ জন পুলিশ সদস্য, ১ জন সেনাবাহিনীর সদস্য, ১ জন আনসার সদস্য, ৩৬ জন নারী, ৩৬ জন শিশু , ২৯ জন শিক্ষার্থী, ৫ জন শিক্ষক, ১২৪ জন চালক, ৭ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৬ জন পথচারী, ৩ জন সাংবাদিক, ৪ জন চিকিৎসক ৩ জন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।

সংগঠিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ২৯.০৩ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৩.১৮ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৫.৬২ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৩.৯৮ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ১১.৪৭ শতাংশ অটোরিক্সা, ৯.৩৬ শতাংশ ব্যাটারী রিক্সা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল ও ১৭.৩৩ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।

সংগঠিত দুর্ঘটনার ২৩.১৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫০.৭৮ শতাংশ পথচারীকে গাড়ী চাপা দেয়ার ঘটনা, ১৮.৪৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ৬.৮৯ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারনে ও ০.৩১ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁছিয়ে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।

এসব দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩২.৯১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৬.৭০ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৫.৩৬ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪.৭০ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে সংঘটিত হয়।

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ –বিআরটিএ বিভিন্ন সময়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে থাকে। প্রিন্ট মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। তারপরও ঘটে দুর্ঘটনা। এর অন্যতম কারন সরকারের নির্দেশনা মেনে না চলা। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিআরটিএ মালিকদের প্রতি যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো হলো যান্ত্রিক ত্রুটি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় না নামানো, নিয়মিত গাড়ি রক্ষণাবেক্ষন করা, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া রাস্তায় গাড়ি না নামানো, বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট অফিস হতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতা যাচাই করে গাড়ি চালক নিয়োগ করা ইত্যাদি। চালকদের প্রতি বিআরটিএ যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা হলো ওভারটেকিং নিষিদ্ধ এলকায়, রাস্তার বাঁকে, সরু ব্রিজে ওভারটেকিং না করা, গাড়ি চালানোর সময় হেডফোন ও মোবাইল ফোনে কথা না বলা, গতিসীমা অতিক্রম না করা, মাদকদ্রব্য বা নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে কিংবা চোখে ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি না চালানো ইত্যাদি। আরো যেসব নির্দেশনা রয়েছে তার অন্যতম হলো একটানা ৫ ঘন্টার বেশি গাড়ি না চালানো, মোটরযান আইন ট্রাফিক আইন ও ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশনা মেনে চলা, গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী বা মালামাল না তোলা, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি না চালানো, নৈশ কোচের চালক কর্তৃক মাঝপথে যাত্রী না তোলা, সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো এবং যত্রতত্র গাড়ি না থামানো, গাড়ি চালানোর পূর্বে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সঠিক ও কর্মক্ষম আছে কিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ইত্যাদি।

ইদানিং মোটর সাইকেলে দুর্ঘটনার মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য মোটর সাইকেল চালক এবং আরাহীদের প্রতি বিআরটিএর নির্দেশনা হলো মোটর সাইকেল চালানোকালে চালক এবং আরোহী উভয়েই বাধ্যতামূলকভাবে হেলমেট পরিধান করা, মোটর সাইকেল চালক এবং আরোহীসহ সর্বোচ্চ ২ জনের বেশি না উঠা, মোটর সাইকেল চালানোকালে রাস্তায় প্রতিযোগিতা না করা প্রভৃতি।

পথচারীদের প্রতি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করা এবং যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে রাস্তার ডানপাশ দিয়ে সাবধানে চলাচল করা, দৌড়ে রাস্তা পার না হওয়া এবং জেব্রা ক্রসিং ফুট ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা পার হওয়া, রাস্তা বা ফুটপাত দিয়ে হাটার সময় মোবাইলে কথা না বলা, রক্ষিত বা অরক্ষিত লেবেল ক্রসিং রেললাইন দিয়ে পার হওয়ার সময় ডানে-বামে দেখে রাস্তা পার হওয়া।

দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে সাধারণ যাত্রী। অথচ একটু সচেতন, সাবধান হলে বা সরকারি নির্দেশনা পুরোপুরি মেনে চললে আমরা অনেক বড় ক্ষতি এড়াতে পারি। এজন্য যাত্রীদের প্রতি সরকারি নির্দেশনা হলো-চলন্ত গাড়িতে চালক হেডফোন বা মোবাইল ব্যবহার করলে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করা, সড়ক দুর্ঘটনার সাথে সাথে স্থানীয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বা উদ্ধারকারী সংস্থা এবং নিকটস্থ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবহিত করা, সময় বাঁচাতে গিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে এবং মালবাহী গাড়িতে যাত্রী হয়ে না উঠা, চলন্ত গাড়িতে উঠানামা না করা। অন্যান্য নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে চালকের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে এমন কিছু না করা, যানবাহনে ধুমপান না করা, নছিমন করিমন ভটভটি এবং জাতীয় মহাসড়কে সিএনজি অটোরিক্সা বা অটোটেম্পুতে যাত্রী হয়ে না উঠা ইত্যাদি।

একটি দুর্ঘটনা –সারা জীবনের কান্না বিষয়টি মাথায় রেখে সবাইকে চলতে হবে। ‘কোনদিন না যাওয়ার চেয়ে দশ মিনিট পরে বাড়িতে যাওয়া ভাল’ মনোভাব নিয়ে চলতে হবে। ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন, আইন শৃংখলা বাহিনীর নির্দেশনা সবাইকে মেনে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাস্তায় মানুষের তুলনায় যানবাহন কম। তাই আমি সবার আগে যাব-এরকম মানসিকতা পরিহার করতে হবে। প্রয়োজন সবারই আছে কিন্তু তা যেন বড় ক্ষতির কারন না হয়ে উঠে- বিষয়টি বুঝে চলতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও বিধি বিধান সকলে মেনে চললে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তাহলে অকালে ঝরে পড়বে না আর কোন তাজা প্রাণ।

লেখক : জি.এম সাইফুল ইসলাম, সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি, চট্টগ্রাম।

আরও পড়ুন