আল-নোমান :: ৯ মাসের মাসের এক গ”র্ভ”বতী নারী তার রিকশা চালক স্বামীর লা’শের জন্য হাসপাতালের এক ম’র্গ থেকে আরেক মর্গে ঘুরছেন। এমন করুণ/বিশ্রী দৃশ্য পৃথিবীতে কখনো যেন আর দেখতে না হয়, সে জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতী করছি। “এমন দৃশ্য ফের দেখার আগে আমার মৃ’ত্যু হোক”
বলছিলাম, রোববার ২১ জুলাই ঢাকা মেডিকেলের কথা। রিকশা চালক আরিফ (২৮)। প্রথম সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছেন, ডাক্তার বলেছে সিজার করানো লাগবে। তাই দিনরাত এক করে পরিশ্রম করছেন। প্রতি দিনের মত শনিবার (২০) জুলাই বিকেলে রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন।
যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া এলাকায় সড়ক থেকে কিছুটা দূরে গলির মুখে রিকশা নিয়ে দাঁড়ালেন। অপেক্ষা যাত্রীর জন্য। কিন্তু সে অপেক্ষা যে যাত্রীর বদলে বু’লে’ট হয়ে তার বুক ছিদ্র করবে সেটি হয়তো জানতেন না এই রিকশা চালক।
আরিফের মৃত্যু বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন তার সহজ-সরল স্ত্রী সামিয়া। অনেকবার তার সাথে একটু কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই ঠিক মতো বলতে পারেননি তিনি। ৯ মাসের একজন গর্ভবতী নারীকে যখন ঘরে নিরাপদে, বিশ্রামে থাকা প্রয়োজন, তিনি তখন স্বামীর লা-শে-র জন্য ঢামেকের এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ঘুরছেন। অপেক্ষার পর অপেক্ষা..।
গত ৩ দিন ধরে যাত্রাবাড়ীর কাজলা থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সড়ক আন্দোলনকারীদের দখলে। কেন আন্দো-লন করছে তারা? তাদের দাবি পুলিশ এলোপাতাড়ি গু-লি করে মানুষদের হ”ত্যা করছে। তাই পুরো এলাকার মানুষ মসজিদে মাইকিং করে সড়কে নেমে এসেছেন।
সকাল ১১ টায় ঢামেকের জরুরি মর্গের সামনে ফ্লোরে মাতম করতে দেখি মোনেকা বেগম (৩০) নামে আরেক নারীকে। খুব করুণভাবে জানতে চেয়েছি কি হয়েছে? শোকে বিহ্বল ওই নারী কোন জবাবই দেননি। পরে মোনাকার ভাই হাসান (ছদ্মনাম) জানান, মো. হোসাইন (১০) তার ভাগ্নে। তার বোন মোনেকা বেগমের একমাত্র সন্তান। গতকাল বিকেলে খেলতে বেরিয়ে ছিলো। গলির মুখে দাঁড়াতেই পুলিশের গু-লি তার পেটের সামনে দিয়ে ডুকে পেছনের দিকে বের হয়। পরে কেউ একজন তাকে ঢাকা মেডিকেল আনার পথে তার মৃত্যু হয়।
গতকাল ঢামেকের জরুরি অবজারভেশনে দু’চোখ কিছুটা খোলা, মুখ কিছুটা হা করা অবস্থায় মৃ-ত্যু-র কোলে ঢলে পড়া এক অজ্ঞাত শিশুর কথা বলেছিলাম। যার ছবি আমি ফোনে তুলে রেখেছিলাম। অজ্ঞাত সে শিশু এই হোসাইন কিনা আমি নিশ্চিত নই। অপেক্ষা করলাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য। জরুরি ম-র্গ থেকে লা-শ বের করতেই মিলিয়ে দেখি সেই শিশুই এই হোসাইন।
একমাত্র সন্তানের লা’শ ম’র্গ থেকে বের করার সাথে সাথে মা মোনেকা বেগমের বিলাপ মাতম বেড়ে গেল। গত দুদিন এ ঢাকা মেডিকেলের জরুরি ম-র্গে-র সামনে এ নিয়ে ৪ জন মা’কে একমাত্র বুকের ধনকে হারিয়ে আহাজারি করতে দেখেছি। এমন দৃশ্য প্রচণ্ড পাষাণ হৃদয়কেও বিগলিত করবে। আর আমি তো আবেগি মানুষ।
গণমাধ্যমকর্মিদের নাকি আবেগ থাকতে নেই। কিন্তু এমন করুণ দৃশ্যের কাছে আমার বার বার হেরে যায়। কিন্তু এতে কেন জানি, আমার বিন্দুমাত্রও আপসোস নেই। ওইসব দৃশ্য তখন আমাকে যতনা বেশি কাঁদিয়েছে, তার চেয়ে বেশি কাঁদাচ্ছে এ ঘটনা লিখার সময়।
যাইহোক, জরুরি মর্গ ছেড়ে আমি ম’র্গ মরচুরীতে সামনে যেতেই দেখি ম’র্গের সামনে নিচে বসে ২৫-২৬ বছরের এক ভাই খু্ব উচ্চস্বরে মাতম করে কাঁদছেন। তার সাথে কথা বলতে আমি বসি। একটু শান্ত হওয়ার পর জানান, তার নাম আব্দুল্লাহ। ছোট ভাই, ওবায়দুল্লাহ (২১) নর্দা এলাকায় পুলিশের গু’লি’তে মৃ’ত্যু’র বরণ করে। ভাইয়ের খোঁজ করতে করতে ঢামেকে এসে জানতে পারেন, ভাই মা’রা গেছে। এর আগে অজ্ঞাত হিসেবে মর্গে পড়েছিলো প্রায় দুদিন।
আব্দুল্লাহ বিলাপ করে বলছেন, ছোট ভাইকে ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ (বাড়ি) থেকে ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছেন মটর ইঞ্জিনের কাজ শেখাতে। ভাইয়ের সাথে একটি গ্যারেজে কাজ শিখতো। শুক্রবার রাস্তায় বের হলে পুলিশের এলোপাতাড়ি গু’লি থেকে রক্ষা পায়নি ওবায়দুল্লাও।
এবার আমি আরও কিছু তথ্যের জন্য, মূল মর্গে যায়, অর্থাৎ যেখানে পোস্টমর্টেম করা হয়। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, বেশ কয়েকটি অজ্ঞাত লা’শ এখনো পড়ে আছে। কিছু কিছুর পেট, শরীর ফুলে উঠেছে। মৃ’ত্যু’র পেরিয়ে গেলো স্বজনরা জানেন না, আপনজনের মৃত্যুর খবর।
এই অজ্ঞাতদের মধ্যে একজনের কথা বেশ মনে আছে। যার বয়স আনুমানিক (৪০) মুখে দাঁড়ি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা ছিলো। বোধ জুমার পড়ে বেরিয়েছিলেন। আমার কাছে ছবি থাকলেও ইন্টারনেট না থাকায়, কোথাও দিতে পারিনি, যাতে স্বজনরা তাদের খোঁজ পায়। এক রাষ্ট্র যন্ত্রের কাছে আমরা খুব অসহায়। অসহায় আমাদের মহান পেশাদারিত্ব। (আজকের মত এখানেই শেষ করলাম, বেঁচে থাকলে আরও লেখা হবে….)
ঢাকার গণমাধ্যমকর্মি আল নোমান এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া।