ঢাকা পোস্টের সৌজন্যে ডেস্ক রিপোর্ট :: ঢাকায় একটি বাড়ির স্বপ্ন কার না আছে? সাধ্য ও সামর্থ্যের মধ্যে থাকলে সবাই এখানে বাড়ির মালিক হতে চায়। যদিও বেশিরভাগেরই অধরা থেকে যায় এ স্বপ্ন। সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙে বা ব্যাংক থেকে ঋণ করে কেউ কেউ হয়তো স্থায়ী একটি ঠিকানা এখানে পান। কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তা যদি চাকরিরত অবস্থায়ই ৯টি ফ্ল্যাট ও দুটি প্লটের মালিক হয়ে যান ঢাকা শহরে, তাকে কী বলবেন?
অনেকটা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়ার মতো এমন ঘটনা ঘটেছে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের ক্ষেত্রে। মনে হচ্ছে সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব সামলানোর ফাঁকে রূপকথার সেই প্রদীপের মতো কোনো একটি প্রদীপ তিনি পেয়ে গেছেন। না হলে কী করে এত সম্পত্তির মালিক হলেন তিনি!
বিপুল এ সম্পদ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান চলাকালে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। আয়কর আইনের আওতায় জরিমানা দিয়ে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বসুন্ধরা ও হাজারিবাগের ৬টি ফ্ল্যাটের মালিক ঘোষণা দিয়ে সম্পত্তি বৈধ করেছেন তিনি।
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের মালিকানাধীন ১১ ফ্ল্যাট ও প্লটের মধ্যে রয়েছে- মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে হলি হাসিনা নামের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ২২৩ হোল্ডিংয়ের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ধানমন্ডির নর্থ ভূতের গলির ৫০ নম্বর হোল্ডিংয়ে গ্যারেজসহ ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, হাজারিবাগ চরকঘাটার ৭নং রোডের সিকদার রিয়েল এস্টেটের ১৪০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর রোডের এফ ব্লকে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের চাঁদ হাউজিংয়ের বি ব্লকে ৭৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে ৪৩/৩ এ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ধানমন্ডির ১১/৩ নম্বর রোডের ৭৭ নম্বরে নিজ ও স্ত্রীর যৌথ নামে ২২৫১ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আউট প্ল্যানের ৮ নম্বর রোডে ১০৭ নম্বর প্লটের সিকদার রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের অর্ধ কাঠা জমি এবং রাজধানীর কাফরুলের ইব্রাহিমপুর মৌজার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ০.১৮৩ অযুতাংশ নাল জমি।
এর মধ্যে ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ক্রয়কৃত কিছু জমিসহ ৬টি ফ্ল্যাট ক্রয়বাবদ ২ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও নগদ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে ২০২০-২০২১ করবর্ষে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৯ (এএএএএ) ধারায় বৈধ করেছেন।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২১ জুন আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদকের ধারণা, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তবান কর্মকর্তায় পরিণত হয়েছেন তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক (বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের মামলা যেহেতু দায়ের হয়ে গেছে, তাই এ বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব দেবো না। আমি আইনিভাবেই বিষয়টি মোকাবিলা করব।
মামুনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিষয়ে এনবিআর ও দুদক সূত্রে যা জানা যায়
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০০৪ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যেসব স্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তার মধ্যে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে ৪ শতাংশ কৃষি জমি ও ৫০ শতাংশ কৃষি ও বসতভিটা ছাড়া সকল সম্পত্তির সরাসরি ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছেন। ক্রয়কৃত স্থাবর সম্পদের মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আউট প্ল্যানের ৮ নম্বর রোডে ১০৭ নম্বর প্লটের সিকদার রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের অর্ধ কাঠা জমির মালিক হয়েছেন ২০০৫ সালে।
মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে হলি হাসিনা নামের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করেন ২০১২ সালে, নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ২২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৭ তলা ভবনে গ্যারেজসহ ১৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক হন ২০০৬ সালে এবং ধানমন্ডির নর্থ ভূতের গলির ৫০ নম্বর হোল্ডিংয়ে গ্যারেজসহ ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করেন ২০০৯ সালে।
এছাড়া ২০০৬-০৭ সালে মালিক হন হাজারিবাগ চরকঘাটার ৭ নম্বর রোডের সিকদার রিয়েল এস্টেটের ১৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। একই রিয়েল এস্টেটের ১৪০০ বর্গফুটের আরও একটি ফ্ল্যাট ২০০৯ সালে ক্রয় করেন। আর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর রোডের এফ ব্লকে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি কেনেন ২০১০ সালে। মোহাম্মদপুরের চাঁদ হাউজিংয়ের বি ব্লকে ৭৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ২০১০ সালে এবং ২০১১ সালে মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে ৪৩/৩ এ ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক হন ক্রয়সূত্রে। অন্যদিকে ধানমন্ডির ১১/৩ নং রোডের ৭৭ নম্বরে নিজ ও স্ত্রীর যৌথ নামে ২২৫১ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি তারা কেনেন ২০১৮ সালে। এছাড়া রাজধানীর কাফরুলের ইব্রাহিমপুরের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ০.১৮৩ অযুতাংশ নাল জমি নিজ নামে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ২০০৯ সালে। আর ওই সকল সম্পত্তি তিনি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের আয়কর নথিতে ১৯ (এএএএএ) ধারায় ঘোষণা দিয়ে বৈধ করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে মামুনের অস্থাবর সম্পত্তির বর্ণনায় রয়েছে- সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিলের (জিপিএফ) সুদসহ প্রায় ৪০ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের বাংলাদেশের আগারগাঁও শাখার গচ্ছিত তিন হিসাবে ৭০ লাখ, ৭৫ লাখ ৩৬ হাজার ও ৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা এবং আলিকো ইন্সুরেন্সবাবদ ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকাসহ ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
এজাহারে যা বলা হয়েছে
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আবদুল্লাহ আল মামুন দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। দাখিলকৃত সম্পদের হিসাবে ২০০২-২০০৩ থেকে ২০২১-২০২২ করবর্ষ পর্যন্ত হিসাবের বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। যেখানে তিনি ২ কোটি ৯২ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ টাকার স্থাবর সম্পত্তির বর্ণনা দিয়েছেন। আর অস্থাবর সম্পদ হলো ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫০ টাকা। সব মিলিয়ে ১৮ বছরে তিনি মোট ৫ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ টাকার সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন।
ওই সময়ে কর পরিশোধ ও পারিবারিক খরচ বাবদ ৫৪ লাখ ৭২ হাজার ৮৯৫ টাকা বাদ দিয়ে তার নীট আয় দেখিয়েছেন ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৩৬ হাজার ১২৪ টাকা। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ক্রয়কৃত কিছু জমিসহ ৬টি ফ্ল্যাট ক্রয়বাবদ ২ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং নগদ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে ২০২০-২০২১ করবর্ষে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৯ AAAAA ধারা অনুযায়ী বৈধ করেছেন। সেখানে তিনি ফ্ল্যাটে বর্গমিটার অনুযায়ী কর পরিশোধ করেছেন। সবমিলিয়ে ৩ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বৈধ করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দুদকের বক্তব্য হলো- আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৬টি ফ্ল্যাট ক্রয়বাবদ ২ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেও ওই সময়ে আয়কর রিটার্নে তিনি তা প্রদর্শন করেননি। এমনকি দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতেও তা উল্লেখ না করে গোপন করেছেন। অথচ আয়কর পরিপত্র ২০২০-২১ অনুযায়ী ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ AAAAA অনুযায়ী রিটার্ন বা সংশোধিত রিটার্ন দাখিলের তারিখে অথবা তার পূর্বে আয়কর অধ্যাদেশের অধীনে কর ফাঁকির অভিযোগে কোনো কার্যধারা বা অন্য কোনো আইনের অধীন আর্থিক বিষয়ে কোনো কার্যধারা চালু হলে এ ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু আবদুল্লাহ আল মামুন ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে তা উল্লেখ না করে অভিযোগের অনুসন্ধান চলা অবস্থায় ২০২০-২০২১ করবর্ষে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন। আয়কর আইন অনুযায়ী তা তিনি গ্রহণ করতে পারেন না বলে মনে করছে দুদক।
মামলার বিবরণ অনুসারে মামুনের মোট অর্জিত ৫ কোটি ৯২ লাখ ১৪ হাজার ১৪৮ টাকার সম্পদের বিপরীতে তার অর্জিত আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ১৯ টাকা। সেক্ষেত্রে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার ১২৯ টাকা। অর্জিত অবৈধ সম্পদের মধ্যে ৩ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন বলে দুদক প্রমাণ পেয়েছে। যে কারণে সম্পদের তথ্য গোপনসহ আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার ১২৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী বাদী হয়ে দুদক আইন ২০০৪-এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় মামলা দায়ের করেন।