কক্সবাজারে মাদক কারবারির তালিকা নিয়ে তেলেসমাতি কারবার !

সম্প্রতি আজগবি মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা নিয়ে পুরো কক্সবাজার জেলা জুড়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠেছে।
যাদের নিয়ে মাদকের তালিকা করা হয়েছে তাদের পেশাদারিত্ব, ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক অবস্থানের সাথে এই তালিকা কোন অবস্থাতেই যায় না বলে মনে করছেন সচেতন মহল। অভিযোগ ওঠেছে, একটি স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতায় এই তালিকার জন্ম হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রশাসন একাধিকবার তালিকা তৈরি করে মাদককারবারীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি যারা তালিকাভুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েক’শ মাদককারবারীদের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পনেই প্রমান করে প্রশাসনের সফলতার। কিন্তু সম্প্রতি যে তালিকা সনাক্তবিহীন গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে ফলাওভাবে প্রচার চলছে অতীতে এমন তালিকার জন্ম হতে দেখেনি দেশবাসী।

৩৭৬ জনের নাম দিয়ে তৈরি করা তালিকা ২৫৫ জনের সংখ্যায় প্রচার হচ্ছে। এছাড়া তালিকাটি কক্সবাজারে কর্মরত সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের মুঠোফোনে ঘুরপাক খাচ্ছে। পাশাপাশি তালিকা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজাল ও রহস্য। তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, লেটার হেড কিংবা স্মারক নাম্বার ছাড়াই প্রণীত এই তালিকা দেখলেই যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবে এটি উদ্দ্যেশমূলক। গুটি কয়েক ইয়াবা ব্যবসায়িদের সাথে নাম দেয়া হয়েছে সামাজিক অবস্থান সম্পন্ন ব্যক্তিদের পাশাপাশি মূলধারার গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদেরও। নানা ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এই তালিকার সূত্র ধরে এখন পর্যন্ত দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা দুইভাবে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। এরপর থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, সাংগঠনিক বিবৃতি নিন্দা ও মামলায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে সাংবাদিক সমাজসহ জেলার সচেতন মহলকে।

অপরদিকে, এই তালিকা ঘিরে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও হয়রানী করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠে এসেছে নানা মহল থেকে। কেউ কেউ বলছেন- ভুয়া তালিকা তৈরি করে নাগরিকদের হয়রানির পাশাপাশি চরম সম্মানহানি করা হচ্ছে। অতীতেও এরকম তালিকায় নাম আসার কথা বলে একটি দুস্কৃতিকারী চক্র নিরপরাধ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা চাঁদাবাজির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে। আবার কেউ বলছেন- এই উদ্ভট তালিকা প্রণয়ন পরবর্তী মাঠে ছেড়ে দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কোনো দুরভিসন্ধি উদ্দেশ্য রয়েছে। কারণ- তালিকায় বেশিরভাগই নাম এসেছে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় একটি মহল জেলায় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় বলে মনে করছেন অনেকেই।

কক্সবাজার জেলায় কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, এই তালিকা ঠিক কিভাবে, কারা প্রণয়ন করেছে তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তালিকাটিতে উল্লেখিত লেখার ভাষা ও গঠন দেখে মনে হয়নি এটি প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত। ধারণা করা হচ্ছে- কোনো একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের ফায়দা লুটতে অতীতের তালিকা কম্পিউটারে কম্পোস করে শুরুতে এবং মাঝে মাঝে সমাজের সম্মানিত নানা পেশার মানুষের নাম সংযুক্ত করে দিয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ব্যয় করে এই তালিকা মাঠে ছেড়ে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই তালিকার প্রশাসনিক কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করেন না তারা।

যেকারণে প্রশ্নবিদ্ধ তালিকা : তালিকায় লেটার হেড, স্মারক নাম্বার কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তালিকাটি পত্রিকায় প্রকাশের ৭/৮ মাস পূর্বে থেকেই কক্সবাজারের গনমাধ্যমকর্মী ও চিহ্নিত কিছু মানুষের মোবাইলে পিডিএফ ফাইল আকারে পৌঁছানো হয়েছে। পাশাপাশি ৬ জানুয়ারি তালিকাটি সর্বপ্রথম দৈনিক বাংলা নামের একটি পত্রিকার মাধ্যমে সবার সামনে আসে। এমনকি উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখিত মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা পরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম তার দেওয়া বক্তব্যে জানিয়েছেন, ২৫৫ জনের যে তালিকার কথা বলছেন সেটি আমার জানা নেই।

এছাড়া তালিকায় তিন নাম্বারে যাকে টার্গেট করা হয়েছে তার কারনেই এই তালিকা অর্ধেক প্রাণ হারিয়েছে। কারণ, উল্লেখিত ব্যক্তির ব্যাপারে লেখা হয়েছে-‘পুলিশের ধৃত ইয়াবার একটি অংশ পুলিশ তার মাধ্যমে বিক্রি করে সোর্সদের টাকা প্রেরণ করে থাকে।’এক্ষেত্রে উক্ত তালিকায় কোথাও ওইসব ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশদের নাম তুলে ধরা হয়নি। পাশাপাশি আরো উল্লেখ করা হয়েছে তাকে গোপনে রিমান্ডে নিয়ে গেলে পুরো জেলার ইয়াবা ব্যবসায়িদের তালিকা পাওয়া যাবে। এই কথায় প্রমান করে কোন একটি সিন্ডিকেট উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাকে গ্রেফতারের আবেদন জানিয়েছেন। এছাড়া যদি তাকে গোপনে রিমান্ডে নিয়ে গেলে পুরো জেলার তালিকা পাওয়া যায় তাহলে এত কষ্ট ও সময় নষ্ট করে এতো লম্বা তালিকা বানানোর কি দরকার ছিল? ফলে এ ধরণের তালিকা নিয়ে বিব্রত প্রশাসনও। একইভাবে তালিকায় ৭ নাম্বারে উল্লেখিত ব্যক্তির ব্যাপারে মন্তব্যের ঘরে লেখা হয়েছে-”১০ বছর পূর্বেও ভিখারীর মতো বসবাস করলেও বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে বাড়ী, গাড়ী ও কয়েকটি ট্রলারের মালিক হয়েছেন। সমস্ত পরিবারের ছেলে, মেয়ের জামাই সবাই সন্ত্রাসী এবং চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী।”
এই ব্যক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়- তিনি দীর্ঘদিনের পুরোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী। কখনোই তিনি হতদরিদ্র বা ভিখারীর মতো ছিলেন না। তিনি মাদকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছিলেন। অথচ উক্ত তালিকায় কোথাও তার ব্যাপারে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়নি মাদকের মামলা থাকার বিষয়টিও।

এছাড়াও তালিকায় উল্লেখিত বেশিরভাগ নামের বিপরীতে মন্তব্যের ঘরে কিছুই লেখা হয়নি। এছাড়া যাদের নাম কখনো ইয়াবার তালিকায় ছিলনা কিন্তু নতুন করে এই তালিকায় নাম আনা হয়েছে তাদের কারো নামের বানান শুদ্ধ নেই। পাশাপাশি পিতার নাম কিংবা ঠিকানাও নেই।

এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দারা বলছেন, এটি সত্যিকারের প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত কোনো তালিকা হত তাহলে মন্তব্যের ঘর কখনোই খালি থাকতো না। পাশাপাশি সবার পেশা, নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা শুদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ থাকত। তাছাড়া তালিকা পিডিএফ আকারে সাংবাদিক কিংবা সাধারণ মানুষের মোবাইলে যাওয়ার বা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। এটি হাস্যকর ও
সংস্থার জন্যই বিব্রতকর। এছাড়াও তালিকায় এমন সব সামাজিক ব্যক্তিবর্গের নাম আনা হয়েছে যাদের ব্যাপারে কখনই মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

এদিকে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত উক্ত তালিকার কথা উল্লেখ করে একজন গণমাধ্যমকর্মী ১৫ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান কিসের তালিকা। পরে উপস্থিত সাংবাদিকরা ইয়াবার তালিকা বলে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, তালিকা হলেই যে কেউ মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। নানা মাধ্যমে অনেক তালিকা বা ইনফরমেশন আমাদের কাছে জমা হয়। আমরা আগে দেখবো এটি কেমন তালিকা। এগুলো যাচাই বাছাই করার দরকার আছে। কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, ১৬ জানুয়ারি সোমবার কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অফিসার ইনচার্জ আহমেদ নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ সাংবাদিকদের জানান, ২৫৫ জন কিংবা সম্প্রতির কোন প্রকার ইয়াবা ব্যবসায়ির তালিকা প্রকাশের সংবাদ তাদের কাছে জানা নেই। বর্তমানে কক্সবাজারে যে তালিকা নিয়ে সমালোচনা চলছে তার সত্যতাও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

উল্লেখ্য, গতকাল ১৫ জানুয়ারী (রবিবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে কক্সবাজার সফর করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এই সফরের ঠিক সপ্তাহ খানেক আগে গত ৬ জানুয়ারী (শুক্রবার) নতুন প্রকাশিত দৈনিক বাংলায় ২৫৫ জনের উক্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। এরপর ১৩ জানুয়ারী (শুক্রবার) দৈনিক ইত্তেফাকেও প্রতিবেদন আকারে উক্ত তালিকার কথা জানানো হয়। এই তালিকায় ইত্তেফাক ৯৩ জনের কথা উল্লেখ করে। উভয় প্রতিবেদনে কোথাও এই তালিকার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়নি তালিকার কোনো সূত্রও। যদিও ছড়িয়ে পড়া এই তালিকায় মোট ৩৭৬ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। তালিকাটিকে তিন ভাগ করে নাম প্রকাশ করা হয়েছে। শিরোনামে লেখা রয়েছে- মাদকের পাইকারী (বড়) বিক্রেতাদের তালিকা (৯৮ জন), মাদকের খুচরা বিক্রেতাদের তালিকা (১২১ জন) এবং মাদকের বহনকারী/সরবরাহকারীদের তালিকা (১৫৭ জন)। সর্বমোট মিলে ৩৭৬ জনে দাঁড়ায়। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৫৫ জনের সংখ্যা দিয়ে।

আরও পড়ুন