আলোর পথের দিশারী চুনতি লাইট হাউস

দেশের বিভাগীয় শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও যেখানে কম্পিউটার ল্যাব কিংবা তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা দৃশ্যমান, সেখানে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা যে কতটা সঙ্গিন তা সহজেই অনুমেয়। সরকার তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানামুখী প্রকল্প হাতে নিলেও এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারী ও ব্যক্তি উদ্যোগে নানাবিধ তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠলেও ব্যয়বহুল হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। দেশে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানার্জনে সহায়ক প্রতিষ্ঠান খুব একটা গড়ে না উঠলেও সাম্প্রতিক সময়ে নজর কেড়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী চুনতি গ্রামে গড়ে ওঠা “চুনতি লাইট হাউস“। এটি একটি ডিজিটাল লাইব্রেরি ও নলেজ সেন্টার, যার উদ্দেশ্য হলো চুনতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করা এবং আগামী প্রজন্মকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। সম্পূর্ণ অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার সম্পর্কিত প্রাথমিক স্বচ্ছ ধারণা, অপারেটিং সিস্টেম, হার্ডওয়্যার, কমিউনিকেশন, স্যোশাল মিডিয়া নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি নানা বিষয়ে পেশাদার শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলছে।

চুনতির কৃতি সন্তান, ইউনিলিভার কনজ্যুমার্স কেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মাসুদ খান এফসিএ, এফসিএমএ এবং উনার সহধর্মিণী বাংলাদেশের প্রথম মহিলা চাটার্ড একাউন্টেন্ট ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের লীড ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিষ্ট সুরাইয়া জান্নাত খান এফসিএ’র উদ্যোগে ও চুনতি খান ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম এ ডিজিটাল লাইব্রেরী ও নলেজ সেন্টারটি যাত্রা শুরু করে গত ৫ই মে ২০২২ইং তারিখে। চুনতি খান ফাউন্ডেশনের এ উদ্যোগে জমি দিয়ে স্থাপনা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করে চুনতি ফাতেমা বতুল মহিলা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। স্থাপনা নির্মাণ, সাজসজ্জা, কম্পিউটার সেট আপ, সোলার পাওয়ার ইন্সটলেশন ইত্যাদি আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় হয়েছে অর্ধ কোটি টাকার বেশি। সুপরিসর এই ভবনের একটা রুমে অবস্থান করছে চুনতি লাইট হাউস। বাকি ৫টি সুবিশাল রুম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত “মরফুয়া ও জেবুন্নেসা বেগম মহিলা এতিমখানা ও ছাত্রী নিবাস”। এখানে ২৫ জন এতিম মেয়ে বিনা খরচে থাকা খাওয়া ও পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের মাসিক পরিচালন ব্যয় প্রায় লক্ষাধিক টাকা, যা চুনতি খান ফাউন্ডেশন বহন করে আসছে। জনকল্যাণমুখী মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় চুনতি খান ফাউন্ডেশন এতদঞ্চলে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে চলছে। এলাকার গরীব মেহনতী মানুষের আস্থার ঠিকানা এই খান ফাউন্ডেশন।

সম্পূর্ণ অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান এ লাইট হাউস। বর্তমানে চলমান ২মাসের কোর্সের জন্য ফি নেওয়া হচ্ছে সর্বসাকুল্যে ৫শত টাকা। ইতোমধ্যে ৩০ জনের ২টি ব্যাচ কোর্স সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে আরও ২টি ব্যাচের কোর্স চলমান রয়েছে।

২০২২ সালের ৭ই মে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এম-পি “চুনতি লাইট হাউস” পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি এটিকে এক অনন্য নজির এবং দেশের প্রথম বলে অভিহিত করেন। এ ধরণের ডিজিটাল লাইব্রেরী কিংবা নলেজ সেন্টারের কনসেপ্টের জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

চুনতি লাইট হাউস গ্রামের পিছিয়ে পড়া সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের আগামীর যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এলাকার গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে আগামীতে গ্রাফিকস ডিজাইনার, ওয়েব ডিজাইনার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ডিজিটাল মার্কেটারসহ দক্ষ ও পেশাদার আইটি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তুলতে চায় চুনতি লাইট হাউস। যাতে করে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজ পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। আগামীতে প্রোগামিং শেখানোর মতো পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চুনতি লাইট হাউস। এখানে গেলে দেখা যায়, মনোরম পরিবেশে নিরবিচ্ছিন্ন সোলার পাওয়ার এবং হাই স্পিড ইন্টারনেট সমৃদ্ধ সুবিশাল ল্যাবে বসে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করছে, কম্পিউটার শিখছে, কেউ অনলাইনে ক্লাস করছে, কেউ অংকের জটিল সমস্যার সমধান সার্চ করছে। যে যেটাই করছে, মনের আনন্দে করছে। ওদের শেখার ইচ্ছেগুলো যেন নতুন পাখা মেলে আকাশে উড়তে পারছে চুনতি লাইট হাউস নলেজ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে।

চুনতি লাইট হাউসের ব্যতিক্রমী উদ্যোগের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতিম মেয়েদের জন্য করা “মরফুয়া ও জেবুন্নেসা বেগম মহিলা এতিমখানা ও ছাত্রী নিবাস”। সাধারণত দেশে ছেলেদের বহু এতিমখানা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ছেলেদের মতো মেয়ে এতিমও যে রয়েছে এবং তাঁদের দেখভাল করার জন্যও যে এতিমখানা হতে পারে তার উদাহরণ সম্ভবত প্রথমবারের মতো সৃষ্টি করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এখানে থেকে এতিম মেয়েরা বিনামূল্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি চুনতি লাইট হাউসে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

চুনতি লাইট হাউসের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান চুনতি খান ফাউন্ডেশন এতদঞ্চলে তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার পাশাপাশি সুদীর্ঘ সময় ধরে বহুবিধ জনকল্যাণমুখী মানবিক ও সামাজিক কাজ সম্পাদন করে চলেছে। যার মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা, শীতবস্ত্র বিতরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো উন্নয়ন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহায়তা, গ্রামের পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী থেকে নারী উদ্যোক্তা তৈরি, সুদ বিহীন কৃষি ঋণ বিতরণ, বাস্তুহীনদের গৃহ নির্মাণ সহায়তা ইত্যাদি।

সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে ব্যক্তি উদ্যোগে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান চালানো দুরূহ হলেও কাজটিতে হাত দিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন চুনতির দুই গুণী ব্যক্তিত্ব মাসুদ খান এফসিএ, এফসিএমএ ও তাঁর সহধর্মিণী সুরাইয়া জান্নাত খান এফসিএ।

জানতে চাইলে চুনতি লাইটহাউসের নির্বাহী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবিউল হাসান আশিক বলেন, “আমাদের যাত্রা সবেমাত্র শুরু হলো। এখনো অনেকটা পথ যাওয়ার বাকি। গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রুপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগামীর জন্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে লাইট হাউস। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা যে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং দেশ। গ্রামের পশ্চাদপদ শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা আগামী দিনে ওদেরকে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। যাতে করে ওরা গ্রামে বসেই আয় রোজকার করে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং স্ব-স্ব পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে। আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি সেটি হলো ওদের মনের চোখটি খুলে দেওয়া। ওদেরকে স্বপ্ন দেখার সাহস দেওয়া। কারণ ওদেরও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। উপযুক্ত পরিবেশ আর সুযোগ পেলে ওরাও দেখিয়ে দিতে পারে তাদের সফল হওয়ার সক্ষমতা।

তিনি আরও বলেন, “চুনতি লাইট হাউস শুধু চট্টগ্রাম নয়, গোটা বাংলাদেশের জন্যই এক অনন্য উদাহরণ। সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে নানাবিধ কর্মতৎপরতা পরিলক্ষিত হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চুনতি লাইট হাউস সম্ভবত দেশে প্রথম এই ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান। এমন উদাহরণ আরও সৃষ্টি হলে, যার যার অবস্থান থেকে স্বচ্ছল অবস্থাপন্ন নাগরিকেরা এগিয়ে এলে, আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একদিন অনেকদূর এগিয়ে যাবে।“

আরও পড়ুন