ব্যস্ততায় যেনো শীত গন্ধ দুটোই উধাও বাঁশখালীর শুটকী পল্লীতে

বাঁশখালীর জেলেপল্লীতে মৎস্যচাষীরা শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছে। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে শুরু করে বৃহৎ পরিসরে মাচা তৈরি করে শুকানো হচ্ছে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত নানা জাতের মাছ। বাঁশখালী জুড়ে একাজে নিয়োজিত রয়েছে সহস্রাধিক শ্রমিক। পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। উপকূলীয় এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবীকার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র বঙ্গোপসাগর। এখান থেকেই তারা মৌসুম ভিত্তিক মৎস্য আহরণ করে থাকে। জেলে পাড়ার মানুষের কর্মসংস্থান কেবল সমুদ্র কেন্দ্রীক। অক্টোবর মাসের শুরুতেই মৎস্য ব্যবসায়ীরা গভীর সমুদ্রে পাড়ি দেয় মাছ আহরণে। শীতের মৌসুম একমাত্র মৎস্য শুকানোর উপযুক্ত বলে ব্যবসায়ীরা শুঁটকিচাষে ব্যস্ত সময় পার করে। ইতোমধ্যেই বাঁশাখালীতে অর্ধশত কিল্লায় শুঁটকি উৎপাদন পুরোদমে শুরু হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাঁশখালী থেকে কোটি টাকার শুঁটকি বিদেশে রফতানি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে শুঁটকী চাষে সংশ্লিষ্টরা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাঁশখালীর সুস্বাদু ও বিষমুক্ত শুঁটকি বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও রফতানি হয়ে আসছে। বর্তমানে বাঁশখালীর জেলে পল্লীগুলোতে শুঁটকি শুকানোর ধুম পড়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ছনুয়া, বড়ঘোনা-গন্ডামারা, পুঁইছড়ি, নাপোড়া, শেখেরখীল, শীলকূপের মনকিচর, জালিয়াখালী নতুন বাজার সংলগ্ন শুঁটকিপল্লী, সরল, বাহারছড়া ও খান-খানাবাদের সাগর উপকূল ও নদীর চরগুলোতে অর্ধশত শুঁটকি মহালে সহস্রাধিক জেলে শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। অক্টোবরের শুরুতেই শুঁটকি শুকানোর কাজ শুরু হলেও এখন পুরোদমে ব্যাপকভাবে ব্যস্ত সময় কাটছে উপকূলের শুঁটকি পল্লীর চাষীরা। বাঁশখালীর শুঁটকিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় এখানকার শুঁটকির স্বাদ ও কদর যেন আলাদা। বাঁশখালীর সমুদ্র উপকূলের জেলেরা কোন কিছুর মিশ্রণ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে তপ্ত রৌদ্রের তাপে শুঁটকি মাছগুলো শুকান বলেই বাঁশখালীর শুঁটকি খুবই সুস্বাদু এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়।

বাঁশখালীর জেলে পল্লীগুলোতে শুকানো শতশত মণ শুঁটকি ক্রয় করতে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই, আসাদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারের গুদাম মালিকরা বাঁশখালীর শুঁটকী পল্লীতে হাজির হচ্ছেন এবং অনেকেই জেলেদের অগ্রীম টাকা দাদন দিয়ে যাচ্ছেন কাংঙ্খিত শুঁটকির জন্য। শহর থেকে নিয়মিত ৩০ থেকে ৪০ এর অধিক পাইকার ও ৩০০ এর অধিক শহুরে খুচরা ক্রেতা নিয়মিত শুঁটকি নিয়ে যায় বাঁশখালীর বিভিন্ন শুঁটকির কিল্লা থেকে। ক্রেতাদের কাছে বাঁশখালীর শুঁটকির আলাদা সুনাম থাকায় অন্যান্য এলাকার শুঁটকি এখন বাঁশখালীর শুঁটকি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতাও শুরু হয়েছে বাজারে এমনটি জানান শুঁটকী ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে বাঁশখালীর সুনাম ক্ষুণ্ণ করার পাঁয়তারা হলেও এখানকার শুঁটকির জনপ্রিয়তা কোনক্রমেই কমছে না বলে জানান উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট জেলেরা।

চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জের শুঁটকি মাছের পাইকার ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর বাঁশখালী থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় কোটি টাকার শুঁটকি। চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারসহ বড় বড় গুদামে হাজার হাজার মণ শুঁটকি গুদামজাত করে বর্ষা মৌসুমেও উচ্চদামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে অনেক ব্যবসায়ী লাভবান হন। সাগর থেকে জেলেদের আহরণ করা মাছ আধুনিক পদ্ধতিতে শুকানোর কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর সাগর উপকূলে লাখ লাখ টাকার মাছ বিনষ্ট হয়। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে তাই শুঁটকি চাষীদের উন্নত ও আধুনিক চাষাবাদে প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নাই বলে জানান তারা।

জালিয়াখালী নতুন বাজার সংলগ্ন শুঁটকি চাষী মো. মহি উদ্দিন জানান, ‘অক্টোবরের শুরু থেকে মাচা তৈরি করেছি। তখন থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে মাছ শুকিয়েছি। এখন ব্যাপকভাবে কাজ শুরু হয়েছে। এ ব্যস্ততা প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস থাকবে। গত বছরের তুলনায় কিল্লার পরিমান ও পরিধি বহুগুণ বাড়িয়েছি। দিনব্যাপী পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমকিরাও ব্যস্ত সময় দিচ্ছে। আমার কিল্লায় ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছে। নারী শ্রমেিকর বেতন ৪শত থেকে ৫শত টাকা, পুরুষ শ্রমিকের বেতন ৭শত থেকে ৮শত টাকা পর্যন্ত। এখানে উৎপাদিত শুঁটকির মধ্যে লইট্যা, ছুরি, রূপচান্দা, ফাইস্যা, মাইট্যা, কোরাল, রইস্যা, পোঁহা ও চিংড়ী শুঁটকি অন্যতম। বাঁশখালীতে উৎপাদিত উন্নতমানের শুঁটকি দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব শুঁটকি এখন রফতানি হচ্ছে দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত ও পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

বেশকয়েজন শুঁকটি চাষিদের সাথে কথা বললে তারা জানান, এখানে উৎপাদিত এসব শুঁটকি রফতানি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে বাঁশখালীর ঘের মালিকসহ চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও চকবাজারের বড় বড় গুদাম মালিকরা। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাঁশখালী থেকে কয়েক কোটি টাকার শুঁটকি বিদেশে রফতানি হবে বলে জানান তারা। কাঁচা মাছ বিক্রি করে অনেকে শুঁটকির চেয়ে বেশী লাভবান হয়। তাছাড়াও এ অঞ্চলের কিছু কিছু শুঁটকি চাষীরা কিল্লা তৈরি করছে, মাছ অহরণে সাগরে ছুটেছে। শীত মৌসুমে তারা কাঙ্ক্ষিত মৎস্য শুঁকিয়ে ভাল দামের প্রত্যাশা করছে।

শুঁটকি চাষীরা আরো জানান, বাঁশখালীর জেলেরা শুঁটকি উৎপাদন করতে সরকারি-বেসরকারি কোন সাহায্য-সহায়তা পায় না। নিজ উদ্যোগে এবং জীবনের তাগিদেই তারা কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করে। শুঁটকি উৎপাদনকারী জেলেদের কোন পৃষ্ঠপোষকতা বা ব্যাংক ঋণ সুবিধা না থাকায় তারা ধর্না দেন চট্টগ্রাম শহরের গুদাম মালিকদের নিকট। জেলেরা বড় বড় গুদাম মালিকদের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা দাদন এনে এসব শুঁটকি শুকানোর কারণে স্বল্প মূল্যে শুঁটকিগুলো গুদাম মালিকদের হাতে তুলে দিতে হয়। বাঁশখালীর প্রায় হাজার হাজার জেলের অন্যতম আয়ের উৎস ওই শুঁটকি চাষ।শুঁটকী চাষে রয়েছে অনেক সমস্যা। মাছ শুকানোর জন্যে প্রয়োজন বিশাল এলাকা। যেখানে গড়ে উঠে শুঁটকি পল্লী। এখন আগের মতো খোলা জায়গা তেমন পাওয়া যায় না। সীমাবদ্ধতা ও নানা সমস্যা থাকা স্বর্তেও ৬-৭ হাজার মৎসজীবীর সাথে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে জড়িত।