রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ ও শিক্ষার ত্রুটি সারাবে কে

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন

আমাদের সমাজে আসলে হচ্ছেটা কী? এভাবে কোথায় চলেছি আমরা? প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সংবাদ আমরা শুনতে পাই, তা নাগরিক হিসেবে আমাদের ব্যথিত, মর্মাহত ও মাঝে মধ্যে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তোলে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) সংঘটিত এক অভিযোগ অনুসারে ক্যাম্পাসে রাতের বেলা পাঁচ তরুণ মিলে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা বন্ধুকে মারধর করে তাদের সবকিছুও কেড়ে নেয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এমন যৌন হয়রানি ও হেনস্তা এবারই প্রথম নয়, এর আগে গত ২৮ জুন বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেনে ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে!

এদিকে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর চবি ক্যাম্পাসের ভেতরেই দুই ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগ উঠলেও বরাবরের মতোই ওই সময় এগুলোর কোনোটারই বিহিত হয়েছে বলে শোনা যায়নি। যদিও অন্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চবিতেও যৌন হয়রানি নিপীড়ন নিরোধ সেল আছে, তবুও অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নাকি এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানে না। সবচেয়ে উদ্বেগ আর হতাশার ব্যাপার হচ্ছে, এর প্রায় সব ঘটনায় যারা জড়িত বলে নাম এসেছে; তাদের একটি বড় অংশই ছাত্র নামধারী এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী- এমন সংবাদ নাগরিক হিসেবে আমাদের বিবেক আর মনুষ্যত্বকে বিলীন করে মাথা হেট করে দেয়। একই সঙ্গে যেই ক্যাম্পাস সবার জন্য নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত হওয়ার কথা, সেখানে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে। আমরা আরও শঙ্কিত। কারণ এমন বিবেকবর্জিত নানা পৈশাচিক ঘটনার পরও আমরা কেমন যেন নিশ্চুপ!

চবিতে সংঘটিত সর্বশেষ ঘটনায় অভিযুক্তদের অনেককেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও নানা চাপে অভিযুক্ত ছাত্রদের ছাত্রত্ব বাতিল করে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে গত বছরের ঘটনায় অভিযুক্তদেরও প্রায় দশ মাস পর এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে সর্বশেষ ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের সঙ্গে বহিরাগতরাও নাকি ছিল এবং তাদের আটকও করা হয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এমন একটি জায়গায় এসে এ জাতীয় জঘন্য অপরাধ করার সাহস পায় কীভাবে? তাদের পেছনের শক্তি কারা?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারকারী ছাত্র সংগঠনের নানা গ্রুপ, উপ-গ্রুপ নিয়ে বিগত দিনে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ও রাজনৈতিক সংঘাত আমরা শুনতে পাই। কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্তৃক যখন তার রাজনৈতিক পরিচয়ের দাপটে তারই সহপাঠিনীর ওপর নগ্ন যৌন নিপীড়ন করা হয়, তখন তা শুধু আমাদের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির দেউলিয়াপনার দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ থাকে না। একজন ছাত্র- সে যে রাজনৈতিক মতাদর্শেরই হোক না কেন, তাকে মেধার যোগ্যতাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব অর্জন করতে হয়। তা হলে এত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও এমন কতিপয় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী কেন নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে পারছে না? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রাজনৈতিক পরিচয়ের দাপটে সে তার সহপাঠিনীর বিশ্বস্ততা ও আস্থাভাজন না হয়ে হিং¯্র দানবে পরিণত হচ্ছে? ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি কী তার চিন্তাশক্তিরও বিলোপ ঘটিয়েছে? বিগত দিনের কোনো শিক্ষাই কেন তার কোনো কাজে এলো না? রাজনৈতিক কর্মী হতে গিয়ে ক্ষমতার দাপটে কেন কেউ কেউ মানবিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতা হারিয়ে ফেলছে?

বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় গবেষণার প্রজনন ক্ষেত্র। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবনী চিন্তা-চেতনার বিকাশ প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। কিন্তু আমরা যখন যৌন নিপীড়নের এমন কা-ে গুটিকয়েক কলঙ্কিত শিক্ষার্থীকে জড়িয়ে পড়তে দেখি, তখন আমরা হতাশ না হয়ে পারি না। তাদের এই অনৈতিক কর্মকা-ের ফলে কলঙ্কিত হয় পুরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই- দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ‘মানুষ’ হওয়ার সাধনায় আমরা কি আদৌ এগোতে পেরেছি? মাঝে মধ্যেই আমরা বুঝতে পারি এবং বিভিন্ন বাস্তবতায় উপলব্ধি করি- আমাদের চিন্তার জড়তা, নীতিহীন কদর্য মানসিকতা, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব এখনো পিছু ছাড়ছে না। এর মূল কারণ আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই এখন পরীক্ষাবান্ধব! আমাদের অভিভাবকদের মূল চিন্তা সন্তান জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ পেল কিনা! আমরা ভুলে যাই, অনেক পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করেও একজন মানুষ নৈতিক চরিত্র ও সামাজিক নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে চরম দীনতার মধ্যে থাকতে পারে। অভিভাবকরা নিশ্চয়ই তা মানবেন। তবুও কেন এই চাওয়া? আমাদের এত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও বিভিন্ন ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবুও তো দেখি সমাজজুড়ে মূল্যবোধের সংকট, আদর্শের অনটন আর সংবেদনশীলতার ভীষণ অভাব। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অরাজকতা, ক্ষমতালিপ্সা আর নিয়মহীনতাই যেন আমাদের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা যদি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সত্যিকার অর্থেই যৌন নিপীড়ন এবং এ জাতীয় যে কোনো অবমাননাকর কার্যক্রম বন্ধ করতে চাই- তা হলে অবশ্যই আমাদের শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, শিক্ষাকে শিক্ষাবান্ধব করতে হবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চিন্তার চেয়ে সমাজ ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবস্থাপনার ত্রুটি সারাতে হবে। এ জাতীয় যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় অভিযোগ পাওয়া মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং প্রাথমিক সত্যতা পেলে জামিন অযোগ্য ধারায় কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। আমরা আশাবাদী মানুষ। আমরা স্বপ্ন দেখি, আমাদের উদ্যমী ও সাহসী তারুণ্যের জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জাতীয় নিপীড়নের হবে অবসান।

সফিক চৌধুরী : বিতার্কিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন