শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে পোশাক শিল্প মালিকরা

শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে মালিকপক্ষ। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র, শিল্প এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।

মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে সরকার, বিজিএমইএ’র নেতৃবৃন্দ ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণা পড়ে শোনান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, পোশাক শিল্পে সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে চারজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে সভা করা হয়। মন্ত্রণালয়ের একাধিক টিম কর্তৃক মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করা হয়। পরবর্তীতে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও পোশাক শিল্পের মালিকপক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করা হয়।

যৌথ ঘোষণা হতে আরো জানা যায়, অক্টোবরের মধ্যে সব পোশাক কারখানায় সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া শ্রমিকদের বিদ্যমান হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি এবং ১০ অক্টোবরের মধ্যে কারখানা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের সব বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা ও পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের জন্য ১২০ দিন মাতৃত্বকালীন ছুটি সব কারখানায় বাধ্যতামূলক করা হবে।

নিম্নবর্ণিত ১৮ দফা শ্রমিকপক্ষ এবং মালিকপক্ষ একমত হয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চার উপদেষ্টার উপস্থিতিতে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে স্বাক্ষর করেন পোশাক শিল্প মালিকেরা।

আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সমুহগুলো: 

১. হাজিরা বোনাস, টিফিন ও নাইট বিল: সব পোশাকশিল্প কারখানায় শ্রমিকের বিদ্যমান হাজিরা বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত ২২৫ টাকা, রাত ৮টার পর বিদ্যমান টিফিন বিলের সঙ্গে ১০ টাকা এবং বিদ্যমান নাইট বিল ১০ টাকা বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ১০০ টাকা করা হবে।

২. নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন: অক্টোবর ২০২৪ মাসের মধ্যে সকল কারখানায় সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে।

৩. রেশনিং ব্যবস্থা: আপাতত শ্রমঘন এলাকায় টিসিবি এর মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিকেও শ্রমঘন এলাকায় সম্প্রসারিত করা হবে। শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী রেশন ব্যবস্থার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিকট প্রস্তাব প্রেরণ করা হবে।

৪. বকেয়া মজুরি প্রদান: আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে শ্রমিকের সকল বকেয়া মজুরি বিনা ব্যর্থতায় প্রদান করতে হবে। অন্যথায় শ্রম আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৫. বায়োমেট্রিক ব্ল‍্যাকলিস্টিং: বিজিএমইএ কর্তৃক বায়োমেট্রিক ব্ল‍্যাকলিস্টিং করে শ্রমিকদের হয়রানির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে একটি টেকনিক্যাল টিম পর্যালোচনা করে অক্টোবর ২০২৪ এর মধ্যে প্রতিবেদন প্রদান করবেন।

৬. ঝুট ব্যবসা: ঝুট ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব। চাঁদাবাজি বন্ধসহ শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনায় এ বিষয়ে একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৭. মামলা প্রত্যাহার: ২০২৩–এর মজুরি আন্দোলনসহ ইতিপূর্বে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সকল প্রকার হয়রানিমূলক এবং রাজনৈতিক মামলাসমূহ রিভিউ করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। মজুরি আন্দোলনে নিহত ০৪ (চার) জন শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৮. বৈষম্যবিহীন নিয়োগ: কাজের ধরন অনুযায়ী নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা হবে।

৯. জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা: জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সেবার জন্য শ্রমিক নেতৃবৃন্দ একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’–এ পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হবে।

১০. রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকার: রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গঠিত কমিটি অক্টোবর ২০২৪–এর মধ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করবে।

১১. ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন: প্রাপ্ত সুপারিশের আলোকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী সকল কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন নিশ্চিত করা হবে।।

১২. অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই: অন্যায় এবং অন্যায্যভাবে শ্রম আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না।

১৩. মহিলা শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি: মহিলা শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণ করা হলো।

১৪. ন্যূনতম মজুরি পুনঃ মূল্যায়ন: শ্রমিক ও মালিক পক্ষের ০৩ (তিন) জন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত অতিরিক্ত সচিব (শ্রম) এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নিম্নতম মজুরির বিধি-বিধান ০৬ (ছয়) মাসের মধ্যে সক্ষমতা পর্যালোচনা করবে।

১৫. শ্রম আইন সংশোধন: শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) পুনরায় সংশোধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে ডিসেম্বর ২০২৪ এর মধ্যে সংশোধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে।

১৬. সার্ভিস বেনিফিট প্রদান: শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের সার্ভিস বেনিফিট প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইন এর ২৭ ধারাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।

১৭. প্রভিডেন্ট ফান্ড: কন্ট্রিবিউটার প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পন্ন অন্যান্য দেশের উত্তম চর্চার আদলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১৮. বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট: নিম্নতম মজুরি পুন: নির্ধারণ কমিটি বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সক্ষমতা ও করণীয় বিষয়ে নভেম্বর ২০২৪ এর মধ্যে একটি সুপারিশ প্রদান করবে।

আরও পড়ুন