আওয়ামী আমলে ব্যাপক দুর্নীতি ও অরাজকতার চালানো চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু রেজা মোহাম্মদ নদভী ও তার সিন্ডিকেটের দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। এছাড়াও চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্ত।
জানা যায়, আইআইইউসি লুটপাট করেন সাবেক এমপি আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী ও তাঁর সহযোগীরা। তার নেতৃত্বাধীন এই সিন্ডিকেটে স্ত্রী রিজিয়া সুলতানা চৌধুরী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠজনেরাও ছিলেন প্রভাবশালী। মোট ১৬ জনের একটি চক্র মিলেমিশে লুট করেছে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকা।
জানা যায়, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আইআইইউসি টাওয়ার থেকেই ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনাকাটা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিয়োগ, পদোন্নতিসহ বিভিন্ন খাত থেকে অন্তত ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভ্যন্তরীণ তদন্তে জানা গেছে।
এদিকে রিজিয়া সুলতানা আইআইইউসির সব খাতে ছড়ি ঘোরাতেন। মিডিয়া উপদেষ্টা হয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন খালেদ মাহমুদও। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টের কোনো সম্পত্তি থেকে কোনো ধরনের সম্মানী কিংবা অর্থ নেওয়ার সুযোগ না থাকলেও তারা নিয়েছেন নিয়মনীতি না মেনেই।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক টাওয়ার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য ও দলিলে দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে।
আইআইইউসির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি খাত থেকে কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে তা জানতে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করছেন তারা। তদন্ত শেষে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দপ্তর থেকে যে হিসাব এসেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, ৫০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে চট্টগ্রাম- ১৫ আসন থেকে দশম ও একাদশ নির্বাচনে দুবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন নদভী। জামায়াতের কর্মপরিষদের সাবেক সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর আমির প্রয়াত মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরীর জামাতা নদভী একসময় আইআইইউসি’র শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে বরখাস্ত করা হয় তাকে। জামায়াতের তকমা গায়ে থাকলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হওয়ার পর চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নদভী।
উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান নদভী ও অন্যদের বিরুদ্ধে সম্মানীর নামে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২১ সালে বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হয়েই নদভী একটি বলয় তৈরি করেন। আইআইইউসি টাওয়ার থেকে সম্মানীর নামে নেজামউদ্দিন নদভী বিধিবহির্ভূতভাবে একাই ১০ লাখ ৯ হাজার টাকা নিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী রিজিয়া সুলতানা চৌধুরী ৩ লাখ ৩৭ হাজার, প্রফেসর ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদ ৬ লাখ ৩০ হাজার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান ড. ইঞ্জিনিয়ার রশিদ আহমদ চৌধুরী ২ লাখ টাকা, ট্রেজারার প্রফেসর ড. মোহাম্মদ হুমায়ন কবির ৪৫ হাজার, এসিএফডি পরিচালক আফজাল আহমদ ৪৫ হাজার, ড. মুহাম্মদ মাহী উদ্দীন ৪৫ হাজার, রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ শফীউর রহমান ৪৫ হাজার, সরওয়ার আলম ১০ হাজার, জিয়াউর রহমান ১০ হাজার, মুহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ১০ হাজার, মিডিয়া উপদেষ্টা খালেদ মাহমুদ ১ লাখ, প্রসেফর মোহাম্মদ সালেহ জহুর ১ লাখ, প্রফেসর ফসিউল আলম ৫০ হাজার এবং প্রফেসর আবদুর রহিম ২৫ হাজার টাকা মাসিক সম্মানী হিসেবে নিয়েছেন। সম্মানীর নামে টাওয়ার ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৬ জন তিন বছরে ১০ কোটি ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা নিয়েছেন। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্ট্রের কোনো সম্পত্তি থেকে কোনো ধরনের সম্মানী কিংবা অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ।
এ ছাড়াও নদভী গাড়ি ক্রয়ের জন্য ৬৫ লাখ টাকা ঋণ, ছেলের বিদেশ যাওয়ার জন্য ঋণ, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য অর্থ খরচ করেছেন ইচ্ছামতো।