চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শুরু হওয়া বহুল প্রত্যাশিত বে-টার্মিনাল প্রকল্প বর্তমানে ‘গতিহীন’ হয়ে পড়েছে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারের পরিবর্তন ও পরবর্তী প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার কারণে গত চার মাস ধরে প্রকল্পটির কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এই প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে আরও সক্ষম করে তুলবে, তবে বর্তমানে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে প্রকল্পটির সহায়তায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে, কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি এখনো সম্পন্ন হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের অব্যাহত অনীহা এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে চুক্তির সই হতে দেরি হচ্ছে, যা প্রকল্পের সময়সূচি ও প্রভাবকে দীর্ঘসূত্রিত করছে।
প্রকল্পটির ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল ২০১৪ সালে, যখন বন্দর কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় বে-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেছিল। তখন থেকে প্রকল্পটির নকশা এবং পরিবেশগত মূল্যায়ন বেশ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটির কারিগরি, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত সমীক্ষা শেষে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১ হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ দুটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং ১ হাজার ৫০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস টার্মিনালসহ মোট তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের কথা ছিল।
২০১৯ সালের নভেম্বরে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পরই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। তবে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং সরকার পতনের পর থেকেই প্রকল্পটির গতি থমকে যায়। নৌ পরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা এটা নিয়ে আলাপ করেছি এবং প্রকল্পটি চলমান থাকবে, তবে বাস্তবতায় কিছু পরিবর্তন আসছে।
এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে, ১০ মিটার ড্রাফটের ছোট জাহাজের জন্য ব্যবহারযোগ্য বন্দরটি বড় জাহাজের জন্য প্রস্তুত হবে। নতুন বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে ১২ মিটার ড্রাফটের এবং ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের বড় জাহাজও সেখানে ভিড়তে পারবে, যা বাণিজ্যিক খরচ কমাবে এবং দ্রুততার সাথে পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। বাংলাদেশের শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন জানিয়েছেন, এই প্রকল্পটি ভবিষ্যতে দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের বন্দরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং কাজ দ্রুত শুরু করা উচিত।
তবে, প্রকল্পের বাস্তবায়নে একাধিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। বন বিভাগের ৫১ একর জমি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রকল্পের অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, প্রকল্পের প্রকৃত অগ্রগতি ঠিকমতো পর্যালোচনা করা হচ্ছে না, এবং ন্যাভিগেশনাল চ্যানেল ও ব্রেকওয়াটারের জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ অনুমোদন করলেও প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে শুরু হয়নি।
প্রকল্পটির সম্ভাব্য সুবিধাগুলোর মধ্যে প্রধান হলো, চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরও বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে পারবে। বর্তমানে, বাংলাদেশকে বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ করতে হলে বড় আকারের জাহাজ পরিচালনা করতে হবে, যা বর্তমানে সম্ভব নয়। বে-টার্মিনাল নির্মাণ হলে এই সক্ষমতা অর্জিত হবে। এর ফলে, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্প বর্তমানে দেশের প্রথম সবুজ বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনাটি অনুযায়ী, ৩০ শতাংশ এলাকাকে বনায়নের জন্য বরাদ্দ রাখা হবে, যা পরিবেশগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পটি ২০৪০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান টার্মিনালগুলোর কার্যক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি কমাবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের বাণিজ্যিক চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সব মিলিয়ে, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, তবে এটি কার্যকরী হতে আরও সময় ও উদ্যোগের প্রয়োজন।