দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন স্পট বাঁশখালী ইকোপার্ক। বামের ও ডানের ছড়ার স্বচ্চ লেক এ পার্কের অন্যতম আকর্ষণ। সুউচ্চ পাহাড় বেষ্টিত, সবুজের ছায়া ঘেরা এ পার্কের প্রবেশধারে একসময় মনজুড়ানো ফুলের উদ্যান ছিল। এখন সে ফুলের উদ্যান নেই, চিরচেনা সৌন্দর্য্যও আর নেই। অনুন্নত অবকাঠামো, দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণ অবস্থায় দিন দিন পর্যটক হারাতে বসা বাঁশখালী ইকোপার্কে প্রতি বছরের ন্যায় এ বারও শীতের শুরুতেই পরিযায়ী পাখির দেখা মেলেছে। পরিযায়ী পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত বাঁশখালী ইকোপার্ক। এরা পার্কের সৌন্দর্য্য বাড়িয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শীত পড়তেই ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি ভিড় করছে এখানে। এক সময়ে শীতের মৌসুমে এ পার্কে প্রচুর পরিযায়ী পাখির আনাগোনা লেগে থাকতো। কিন্তু ক্রমশ সেই সংখ্যা কমে গিয়েছিল। স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত খবর, গত বছর থেকে ফের পাখির সংখ্যা বেড়েছে। এ বারও প্রচুর পাখি এসেছে।
পাখি বিশারদরা জানান, এই সময়ে শীতপ্রধান দেশগুলোতে ঠান্ডা বাড়ে। সেখান থেকে পাখিরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সাধারণত কম ঠান্ডার দেশে চলে আসে। কিছু দিন কাটিয়ে আবার ফিরে যায় আপন দেশে। এদের পছন্দের একটি স্পট বাঁশখালী ইকোপার্ক। সাইবেরিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, এশিয়া, হিমালয় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি নভেম্বর-ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে আমাদের দেশে আসে। শীত মৌসুম শেষ হলে আবার তারা পাড়ি জমায় নিজ নিজ দেশে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ‘বাঁশখালী ইকোপার্কে সৌন্দর্য্য বাড়িয়েছে ভিনদেশীয় পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। বামের ও ডানের ছড়া লেকেই এরা অবস্থান করেছে। পার্কের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও ঝুলন্ত সেতু থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের বিচরণ দেখা যায়। সন্ধ্যা গড়ালেই এদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয় পুরো পার্ক এলাকা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করেছে এ পরিযায়ী পাখি। ঝাঁক বেঁধে কখনো খোলা আকাশে উড়াল দেওয়ার দৃশ্য, কখনো স্বচ্চ লেকে দলবেঁধে বিচরণের দৃশ্য দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। শীত মৌসুমে এ পার্ক যেন এক পাখি পাড়ায় রুপ নিয়েছে।
২০০৩ সালে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বন্য প্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, ইকো ট্যুরিজম ও চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে প্রায় ১ হাজার হেক্টর বনভূমি নিয়ে সরকারী উদ্যোগে বাঁশখালী ইকোপার্ক নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৬ সালে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর বনভূমি নিয়ে চুনতি অভয়ারণ্য গড়ে তোলার ঘোষণা দিলে বাঁশখালীর বামের ছড়া ও ডানের ছড়া এই অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে থেকে প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন ঋতু বৈচিত্রের সাথে বাঁশখালী ইকোপার্কের সৌন্দর্যও পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পার্কের সাড়ে ছয়শত হেক্টর বনভূমিতে ঝাউ বাগান, ভেষজ উদ্ভিদের বন ও অর্নামেন্টাল গাছ সহ তিন শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।
২০০৮ সালে প্রলয়ংকরী পাহাড়ি ঢলের পানি তোড়ে বাঁশখালী ইকোপার্কের বামের ছড়ার বাঁধ ভেঙে ইকোপার্কের বেশ কিছু স্থাপনা ও হাইড্রোইলিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি তছনছ হয়ে যায়। পরে কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণ হলেও পার্কের উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে পিকনিক স্পট, দ্বিতল রেস্ট হাউজ, হিলটপ কটেজ, রিফ্রেশমেন্ট কর্ণার, দীর্ঘতম ঝুলন্ত ব্রিজ, ওয়াচ টাওয়ার আপন সৌন্দর্য্য হারায় এবং মিনি চিড়িয়াখানাটিও বিলুপ্ত হয়। এর পর থেকে উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোগত কোনো সংস্কার হয়নি।
২০১১ সালের ২১ আগস্ট বাঁশখালী ইকোপার্কে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের তথ্য সম্বলিত একটি তথ্য ও শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এছাড়া এখানে মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, চিত্রা বিড়াল, বাঘ, মেছো বাঘ ও পাখির প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। শীতকালে অতিথি পাখির কলরবে সরব হয়ে উঠে এই ইকোপার্কের সবুজ প্রকৃতি। ইকোপার্কের সুউচ্চ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশি, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা ঝর্ণাধারা আর বিকাল বেলায় সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য পর্যটকদের মোহিত করে। অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন না হওয়ায় পার্কের সৌন্দ্যর্য দিনদিন ম্লান হচ্ছে।
বাঁশখালী ইকোপার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইসরাঈল হক প্রতিবেদক কে বলেন, ‘বন বিভাগ থেকে বাঁশখালী ইকোপার্কটিকে একটি আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ইকোপার্ক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমানে ইকোপার্কের মাস্টার প্ল্যান তৈরির কাজ চলমান আছে। ঢাকার আরণ্যক ফাউন্ডেশনের একটি বিশেষজ্ঞ টিম এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজে কনসাল্টেন্সি ফার্ম হিসেবে কাজ করছে। মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন শেষ হলে সে অনুসারে একটি প্রজেক্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাঁশখালী ইকোপার্ক এর উন্নয়ন সম্ভব হবে। আশা করা যায় বাঁশখালী ইকোপার্ক একটি নান্দনিক পর্যটনস্পটে রুপ ফিরে পাবে।’